হাজির জন্য মদিনা শরিফ যাওয়া, রাসুল (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা হজের সপ্ত ওয়াজিবের অন্যতম। নবীজি (সা.) মদিনায় যে প্রধান মসজিদটি নির্মাণ করেন এর নাম ‘মসজিদে নববি’, যা মদিনা শরিফ নামেই পরিচিত। এই মসজিদে একাদিক্রমে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়ার ফজিলত সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছে আর কোনো নামাজ কাজা করেনি, সে মুনাফেকি থেকে মুক্ত হবে এবং দোজখের আজাব থেকে নাজাত পাবে।’ (মুসনাদে আহমদ, আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব)। পবিত্র মক্কা শরিফের পরেই এটি শ্রেষ্ঠ স্থান।
মদিনায় প্রিয় নবীজি (সা.)-এর সমাধি, অর্থাৎ কবর বা মাকবারা অবস্থিত। একে রওজা মোবারক বা মাকবারা শরিফও বলা হয়। মদিনার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নবীজি (সা.)-এর রওজা শরিফ। হজরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরার মধ্যে তাঁর মাজার শরিফ অবস্থিত। তাঁরই পাশে হজরত আবুবকর (রা.) ও হজরত উমর (রা.)-এর মাজার। এটি বর্তমানে মসজিদে নববির অন্তর্গত।
রওজা শরিফ জিয়ারতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর আমার রওজা মোবারক জিয়ারত করল, সে যেন আমাকে আমার জীবদ্দশায় দর্শন করল।’ (বায়হাকি)। মদিনা মুসলমানদের প্রাণের ভূমি। মদিনা হলো নবীজির শহর; শান্তির নগর। নবীজি আরও বলেন, ‘যে হজ করল, কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না; সে আমার প্রতি জুলুম করল।’ (তিরমিজি)।
মদিনা শরিফ মক্কা শরিফের উত্তর দিকে হওয়ায় মদিনা শরিফের কিবলা দক্ষিণ দিক। মসজিদে নববির পশ্চিম পাশের প্রবেশপথকে বাবুস সালাম বলা হয়। এই দরজা দিয়ে মসজিদে নববিতে প্রবেশ করতে হয়। মসজিদে নববির পূর্ব পাশের বহির্গমন দরজাকে বাবে জিবরাইল বলা হয়। এখানে হজরত জিবরাইল (আ.) অহি নিয়ে এসে প্রায় অপেক্ষা করতেন। তাই এই নাম হয়েছে। রওজা শরিফ এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসুলে করিম (সা.)-এর মিম্বার পর্যন্ত স্থানকে রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। এটি দুনিয়াতে একমাত্র জান্নাতের অংশ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার রওজা ও মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থানে বেহেশতের একটি বাগিচা বিদ্যমান।’ (বুখারি ও মুসলিম)। এখানে প্রবেশ করা মানে জান্নাতে প্রবেশ করা।
মসজিদে নববিতে রাসুলে করিম (সা.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজের ইমামতি করতেন, সেই মিহরাবকে মেহরাবুন নবী বা নবীজি (সা.)-এর মিহরাব বলা হয়। এখানে হজরত জিবরাইল (আ.) যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন তথাকার মিহরাবটি মিহরাবে জিবরাইল বা হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মিহরাব নামে পরিচিত।
নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে সবার আগে আমি মদিনাবাসীর জন্য শাফায়াত করব, তারপর মক্কাবাসীর জন্য; তারপর তায়েফবাসীর জন্য।’ (তাবারানি শরিফ)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘হে আল্লাহ! ইবরাহিম (আ.) আপনার খাস বান্দা, আপনার খলিল ও নবী ছিলেন। আমিও আপনার বান্দা ও নবী। তিনি মক্কার কল্যাণ ও বরকতের জন্য আপনার কাছে দোয়া করেছিলেন, আমিও মদিনার কল্যাণ ও বরকতের জন্য তেমনি দোয়া করছি; বরং তার চেয়ে অধিক।’ (মুসলিম শরিফ)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করল এবং আমার মৃত্যুর পর আমার রওজা জিয়ারত করল, সে আমার জিয়ারতের সৌভাগ্য ঠিক তার মতো লাভ করল, যে আমার জীবদ্দশায় আমার জিয়ারত লাভ করেছে।’ (বায়হাকি, শুআবুল ইমান, মিশকাত শরিফ)। ‘যে আমার কবর জিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল।’ ‘আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমার কবর জিয়ারত করল না, তার কোনো ওজরই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (ইলমুল ফিকহ)।
‘যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারতের জন্য এল এবং এ ছাড়া তার আর অন্য কোনো কাজ ছিল না, তার জন্য শাফায়াত করা আমার ওপর হক (দায়িত্ব ও কর্তব্য) হয়ে গেল।’ (ইলমুল ফিকহ)। ‘যে ব্যক্তি হজ করল; কিন্তু আমার কবর জিয়ারত করল না; সে আমার ওপর জুলুম করল।’ (ইবনে আদি, সুনানে হাসান, শারহে লুবাব)। এসব হাদিস শরিফ থেকে প্রমাণিত হয়, রওজা পাক জিয়ারত করা ওয়াজিব। মুজতাহিদ ইমাম ও ফকিহ উলামারা এই ফাতাওয়া ও সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। (আসান ফিকাহ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২৫০-২৫১)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম-এর সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail, com