সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীলেরাই জয়ী হয়
মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। মানব সৃষ্টির আগে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলেছিলেন, ‘আমি দুনিয়াতে খলিফা স্থলাভিষিক্ত করব।’ (২:৩০)। প্রেরিত প্রতিনিধির দায়িত্ব হলো, প্রেরণকারী মালিকের পক্ষে তার কর্ম সম্পাদন করা। এ জন্য তার মধ্যে সে গুণাবলি থাকতে হবে। কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর রং! তদপেক্ষা উত্তম আর কোন রং হতে পারে?’ (২: ১৩৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত
হও।’ আল্লাহর রং ও গুণ হলো তাঁর নিরানব্বইটি গুণবাচক নাম।
আল্লাহ তাআলা চান মানুষ সেই গুণসমূহ অর্জন করুক এবং মানুষের মধ্যে এসব গুণ বিকশিত হোক, সমাজে এসব গুণের চর্চা হোক। মহান রাব্বুল আলামিনের অসংখ্য গুণের অন্যতম হলো ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতা।
মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই নবী–রাসুল প্রেরণের মূল লক্ষ্য। এ মহান লক্ষ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)–কে পাঠিয়েছেন মানবতার উৎকর্ষের পূর্ণতা প্রদানের জন্য। তিনি বলেন, ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘(হে মুহাম্মদ সা.) নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (৬৮: ৪)।
মানবিক উত্তম গুণাবলির অন্যতম হলো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। পবিত্র কোরআনে স্থানে স্থানে মহান আল্লাহ নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরম সহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় প্রদান করেছেন। ধৈর্যের আরবি হলো সবর। সহিষ্ণুতার আরবি হলো হিলম। সবর ও হিলম শব্দদ্বয়ের মধ্যে ঈষৎ তাত্ত্বিক পার্থক্য বিদ্যমান। সাধারণত সবর তথা ধৈর্য হলো অপারগতার কারণে বা অসমর্থ ও অসহায় হয়ে প্রতিকার চেষ্টা বা প্রতিরোধ না করা। হিলম অর্থাৎ সহিষ্ণুতা মানে হলো শক্তি–সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ না করা। এ অর্থে সবর বা ধৈর্য অপেক্ষা হিলম তথা সহিষ্ণুতা উন্নততর অবস্থা। তবে এ উভয় শব্দ কখনো কখনো অভিন্ন অর্থে তথা উভয় অর্থে ও একে অন্যের স্থানে ব্যবহৃত হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং সুসম্পর্ক স্থাপনে আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে অবিচল থাকো, আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (৩: ২০০)। আল্লাহ তাআলা ধৈর্যধারণকারীর সঙ্গে থাকেন; আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যার সঙ্গে থাকবেন, তার সফলতা অবধারিত ও সুনিশ্চিত।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সহিত আছেন।’
(২: ১৫৩)। নামাজ–কালাম, দোয়া–দরুদ, তাসবিহ–তাহলিল, জিকির–আসকার, দান–খয়রাত, সৎকর্ম, পবিত্রতা ও ধ্যান সহিষ্ণুতা লাভে সহায়ক।
ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম আঠারো বছর পর্যন্ত সহিষ্ণুতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পরম সাফল্য লাভ করেছিলেন। নবী হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম সামান্য অধৈর্য হওয়ার কারণে তাঁকে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতের আঁধারে উত্তাল সমুদ্রবক্ষে হিংস্র মত্স্য উদরে যেতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর উদ্দেশে কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মত্স্য-সহচর (ইউনুস আ.) এর ন্যায় অধৈর্য হয়ো না, সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল।’ (৬৮: ৪৮)।
মানুষ মনে করে, বালা–মুসিবতে বিচলিত না হওয়াই ধৈর্য। মূলত ধৈর্য অনেক ব্যাপক অর্থ ধারণ করে। ধৈর্য তিন প্রকার। যথা: ‘সবর আনিল মাছিয়াত’ অর্থাৎ অন্যায় অপরাধ থেকে বিরত থাকা। ‘সবর আলাত তআত’ অর্থাৎ ইবাদত হলো আল্লাহর আনুগত্য ও সত্কর্মে কষ্ট স্বীকার করা। ‘সবর আলাল মুসিবাত’ অর্থাৎ বিপদে অধীর না হওয়া। (বায়জাবি)।
কোনো ব্যক্তি যদি উপরি উক্ত অর্থে ধৈর্য অবলম্বন করেন, তঁার জীবনে পূর্ণতা ও সফলতা অবশ্যম্ভাবী। প্রথমত: অন্যায়, অপরাধ তথা পাপকার্য থেকে বিরত থাকা সব ধরনের অকল্যাণ ও গ্লানি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। দ্বিতীয়ত: ইবাদত ও সত্কর্ম সম্পাদন করা সফলতার একমাত্র সোপান।
তৃতীয়ত: প্রতিকূলতায় দৃঢ়পদ থাকা লক্ষ্যে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম।
সুতরাং ‘সবর কামিল’ বা পরিপূর্ণ ধৈর্যই মানবজীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে। আমাদের উচিত সব অনভিপ্রেত অবস্থায়, যেকোনো অযাচিত পরিবেশ ও অনাহূত পরিস্থিতিতে নিজেকে সংযত রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া। তবেই আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথি হবে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গী হবেন।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com