নিষ্পাপ শিশু-কিশোরদের মন খুবই সরল, কোমল ও পবিত্র। মহানবী (সা.) শিশুদের মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। যেকোনো শিশুকে তিনি নিজের সন্তানের ন্যায় আদর-সোহাগ করতেন। শিশুদের কোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন না করে তাদের সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দানের কথা উল্লেখ করে নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা শিশুসন্তানদের স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (তিরমিজি) রাসুলুল্লাহ (সা.) মানবসন্তানকে সুশিক্ষা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান-খয়রাতের চেয়েও উত্তম।’ শিশুদের উত্তম ও যুগোপযোগী শিক্ষাদানের জন্য তিনি নির্দেশ প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞানদান করো। কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’(মুসলিম)
সুস্থভাবে খেয়েপরে নিরাপদে বেঁচে থাকা প্রত্যেক শিশুর মৌলিক অধিকার। শিশুদের জীবন রক্ষা করার জন্য মহানবী (সা.) সর্বাগ্রে দয়ামায়াহীন আরব পৌত্তলিকদের জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। শিশুদের যথার্থ মর্যাদায় অভিষিক্ত করে তিনি শিশুহত্যায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের গোপন পন্থায় ধ্বংস করবে না।’ (আবু দাউদ) যে জাতি আপন সন্তানকে জীবিতাবস্থায় মাটিচাপা দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করত, ইসলামের নবীর সংস্পর্শে ও হুঁশিয়ার বাণীতে তা পরিত্যাগ করে তারাও সভ্য সমাজ হয়ে ওঠে। এভাবে তিনি কোমলমতি শিশুদের পৃথিবীতে নিরাপদে বেঁচে থাকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
প্রতিটি মুসলিম পরিবার যদি শিশুর শারীরিক সুস্থতা ও বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক বিকাশের দিকে গুরুত্ব না দেয় তাহলে শিশুরা মানবজাতির শ্রেষ্ঠ জনসম্পদে পরিণত হবে না। একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য জাতিসংঘ ‘শিশু অধিকার সনদ’-এর ২৭ নম্বর ধারায় প্রতিটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, সামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে তাদের পর্যাপ্ত মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব বিষয়ে সবার বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার দ্বারাই শিশুরা প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়। শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য রাসুলে করিম (সা.) তাদের সঙ্গে কোমল ব্যবহার নিজে করেছেন এবং অন্যদেরও সদাচার করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি চাইতেন শিশুরা যেন কোনো সময় কষ্ট না পায় বা নির্যাতনের শিকার না হয়। শিশুদের যেকোনো মৌলিক চাহিদা মেটাতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। কোনো শিশু দুষ্টুমি করলে তিনি তাকে কড়া শাসন না করে হাসিমুখে শোধরানোর কৌশল গ্রহণ করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন, ‘যে ছোটকে স্নেহ-মমতা করে না এবং বড়কে শ্রদ্ধা করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বুখারি, তিরমিজি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) শিশুদের খুবই ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আনাস (রাহ.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে আর কাউকেও সন্তানের প্রতি এত অধিক স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশ করতে দেখিনি।’ তিনি প্রাণপ্রিয় কন্যা ‘খাতুনে জান্নাত’ হজরত ফাতেমা (রা.) কে খুবই স্নেহ করে প্রায়ই বলতেন, ‘ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা’। শিশু ফাতেমা (রা.) যখন তাঁর কাছে যেতেন, তিনি উঠে দাঁড়াতেন এবং ফাতেমার হাত ধরে চুমু দিয়ে তাকে মজলিসে বসাতেন।’ (আবু দাউদ) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, ‘সন্তান-সন্ততিকে সম্মান করো এবং তাদের উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (ইবনে মাজা)
নবী করিম (সা.)-এর জীবনে শিশু-কিশোরদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসার অনেক ঘটনা বিদ্যমান। একবার মসজিদে খুতবা দেওয়ার সময় হজরত ইমাম হাসান (রাহ.) ও ইমাম হোসাইন (রাহ.) লাল জামা পরিধান করে কম্পিত পায়ে নানার দিকে এগিয়ে এলেন। রাসুলে করিম (সা.) তাদের দেখে স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি খুতবা স্থগিত রেখে তাদের কোলে তুলে সামনে এনে বসিয়ে তারপর খুতবা শুরু করলেন। তিনি অন্য শিশুদেরও খুব ভালোবাসতেন, তাদের কোলে তুলে নিতেন, চুমু খেতেন, সুন্দর নামে ডাকতেন। সফর থেকে ফেরার পর ছোট ছেলেমেয়েদের উটের সামনে-পেছনে বসাতেন এবং তাদের সঙ্গে কৌতুক করে আনন্দ করতেন। শিশুদের প্রতি দয়ামায়া প্রদর্শন সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে শিশুদের প্রতি দয়া করে না, তাকে দয়া করা হয় না।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি)
মহানবী (সা.) শিশুদের গভীরভাবে ভালোবাসতেন, যেকোনো শিশু পেলে তাকে জড়িয়ে ধরতেন ও আদর-স্নেহ করতেন। তিনি মুসলিম-অমুসলিম সব শিশুকেই ভালোবাসতেন। তাঁর কাছে একদা একটি শিশুকে আনা হলে তিনি তাকে চুম্বন করেন এবং বলেন ‘এরা মানুষকে ভীরু ও কৃপণ করে দেয়, আর এরা হলো আল্লাহর ফুল।’ নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘প্রত্যেক জন্ম নেওয়া শিশু ফিতরাত তথা সহজাত সত্যগ্রহণ করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু তার পিতামাতা হয় তাকে ইহুদি বা খ্রিষ্টান কিংবা অগ্নিপূজক বানায়।’ (বুখারি ও মুসলিম) শিশুদের কোমল ও পবিত্র মনে যদি একবার কোনো খারাপ ধারণা বা ভয়ভীতি প্রবেশ করে, তবে তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে থেকে যায়। তাই নবী করিম (সা.) শিশু-কিশোরদের সঙ্গে খেলাচ্ছলেও মিথ্যা বা প্রতারণা করতে নিষেধ করেছেন।
নবী করিম (সা.) অবহেলিত শিশুদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও বিনোদনের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ধর্মে-কর্মে যথার্থ মানুষ হিসেবে গঠন করেছিলেন। শিশুরা আগামী দিনের দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাই তাদের যদি সুন্দর করে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা যায়; তাহলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে আরও সুন্দর। তাই ইসলামের শিক্ষা সব শিশুই যেন নিরাপদে বেড়ে ওঠে। অথচ আজকের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও আমাদের দেশে শিশুরা কতই না অবহেলিত, নির্যাতিত ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার! সুতরাং ইসলামের সুমহান শিক্ষাকে সামনে রেখে যদি নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের আদর্শ শিক্ষা-দীক্ষায় শিশুদের যথাযথ স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে পিতামাতা, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র তাদের সেবালাভে উপকৃত হবে। শিশুদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা প্রদর্শন করা হলে এমন পরিবারে আল্লাহর করুণা ও দয়া সর্বদাই বর্ষিত হতে থাকবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]