রমজান মাস তাকওয়ার মাস। রমজান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এটা সংযমেরও মাস। রমজান সহমর্মিতার ও গরিবের কষ্ট অনুভব করার এবং তাদের প্রতি সমবেদনা জানানোর মাস। এ জন্যই রমজান মাসে কম খাওয়া ও সংযম অবলম্বন করা জরুরি। বছরের এগারোটি মাস আমরা নিয়মিত তিন বেলা, কখনো কখনো চার বেলা খেয়ে থাকি। রমজান মাসে খাওয়াদাওয়া হলো দুই বেলা। সুতরাং অন্য মাসের খাদ্যব্যয় যা হতো, রমজান মাসে তার চেয়ে অনেক কম ব্যয় হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের সমাজের চিত্র ভিন্ন! রমজান মাসে আমাদের খাওয়ার পরিমাণ যেন আরও বেড়ে যায়। এই মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার কোনোই কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু দেখা যায়, রমজান মাসে ও এর আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। কারণ, আমরা সংযমের পরিবর্তে ভোজনের কাজে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ি। রোজাদাররা যদি সত্যিই রোজার শিক্ষা ও উদ্দেশ্যের প্রতি মনোযোগী হন, তাহলে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি না হয়ে তা স্থিতিশীল বা নিম্নগতি হওয়ার কথা।
রমজান মাসে যে দুটি ইবাদত অর্থ ও খাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তা হলো সাহ্রি খাওয়া ও ইফতার করা। সাহ্রি একটি সুন্নত ইবাদত। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমরা সাহ্রি খাও, কারণ ইহুদিরা রোজা রাখে কিন্তু সাহ্রি খায় না।’ অর্থাৎ মুসলমানদের রোজা আর ইহুদিদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহ্রি খাওয়া আর না খাওয়া। এই সাহ্রির ইবাদতও আজকাল ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা না গেলে সাহ্রির সুন্নত আমলকে অসম্মান করা হবে।
ইফতার সম্পর্কে রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে ওই রোজাদারের সমান সওয়াব দান করবেন, তবে রোজাদারের রোজার সওয়াব কম করা হবে না।’ সাহাবায়ে কিরাম জানতে চাইলেন, ‘কী দিয়ে ইফতার করাতে হবে?’ নবী করিম (সা.) বলেন, ‘একটি খেজুর দিয়ে হলেও, এক গ্লাস দুধ বা শরবত দিয়ে হলেও অথবা এক গ্লাস সাধারণ পানি দিয়ে হলেও সমান সওয়াব পাওয়া যাবে।’ এই হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, ইফতার খুবই সাধারণ ও এর পরিমাণ খুবই সামান্য হবে। আজকাল আমরা সহজ ইফতারের সুন্নতকে ভূরিভোজের আয়োজনে রূপান্তরিত করে ফেলেছি; এটিও গর্হিত কাজ।
একইভাবে আমরা অনেকেই সাহ্রি ইবাদতকেও খাওয়ার উৎসব করে ফেলেছি। এ কারণে ফজরের নামাজের মতো ফরজ ইবাদতও অনেক সময় বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে অধিক পরিমাণে ইফতার আয়োজনের কারণে অনেক সময় মাগরিবের নামাজের জামাত ছুটে যায়। কখনো কখনো এশার নামাজ ও তারাবির নামাজে বিঘ্ন হয়। বারবার অজু–ইস্তিঞ্জার প্রয়োজন হয়, যা ইবাদতে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। ইফতারের পরে এশার নামাজ ও তারাবির নামাজের আগে বা পরে অধিক পরিমাণে আহার করলে আর রাত জেগে ইবাদত করা যায় না এবং শেষ রাতে সাহ্রির আগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া কঠিন হয়।
মনে রাখতে হবে, রমজান মাস ত্যাগের মাস, ভোগের নয়। রমজান মাস দান-খয়রাতের মাধ্যমে আখিরাত অর্জনের মাস, অধিক মুনাফার মাধ্যমে দুনিয়া অর্জনের মাস নয়। যদি কোনো ব্যক্তি বৈধ পন্থায় হালালভাবে ব্যবসা করেন, তবে আল্লাহ তাতেই বরকত দেবেন। অন্যায়ভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দ্বীনদার পরহেজগার রোজাদারদের কষ্ট দিলে, ওই অর্থ ও সম্পদ তাঁর উপকারে না-ও আসতে পারে।
মুনাফার প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত। তাই আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবনে প্রকৃত লাভ কী, তা বলে দিয়েছেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদের এমন এক ব্যবসার প্রতি নির্দেশনা দেব, যা তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? তা হলো তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ইমান আনবে এবং তোমাদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে। এটিই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পারো।’ (সুরা-৬১ সফ, আয়াত: ১০)। এরপরও যারা দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন, তারা বিশ্বাসী দাবি করলেও আসলে তারা মুনাফিক। তাদের উদ্দেশে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা হেদায়েতের পরিবর্তে গোমরাহি ক্রয় করেছে। ব্যবসায় তারা লাভবান হতে পারেনি; আর তারা হেদায়েতপ্রাপ্তও নয়।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৬)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com