হিজরি সালের রমজান মাসের গুরুত্ব বছরের ১২ মাসের মধ্যে খুবই বেশি। কারণ মাহে রমজান মানুষের ইহলৌকিক কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির দিগ্দর্শন কোরআন নাজিলের মাস। মুসলিম উম্মাহর জন্য রমজান মাসের শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত আল্লাহর বাণী ‘আল-কোরআন’। এটি বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) [৫৭০-৬৩২ খ্রি.]-এর প্রতি আল্লাহর কাছ থেকে জিবরাইল ফেরেশতা মারফত সুদীর্ঘ ২৩ বছরে অবতীর্ণ হয়। কোরআন মানবজাতির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও মুক্তির দিশারি বা পথপ্রদর্শক। মাহে রমজানে কোরআনকে সর্বকালের, সর্বদেশের, সর্বলোকের জীবনবিধান ও মুক্তির সনদ হিসেবে পাঠিয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী হিসেবে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
সিয়াম সাধনার মাস হলেও কোরআনের শিক্ষা, তিলাওয়াত, অধ্যয়ন, অনুশীলন ও অনুসরণ ছাড়া রমজানে পুণ্যময় কার্যক্রম পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে মাহে রমজানে কোরআন নাজিল হওয়ার কারণে এ মাসের এত বড় মাহাত্ম্য, এত বেশি মর্যাদা। মহাগ্রন্থ কোরআন আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব এবং মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থ। কোরআন দুই পর্যায়ে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে আল্লাহর আরশে অবস্থিত লওহে মাহফুজ বা রক্ষিত ফলক থেকে সম্পূর্ণ কোরআন
একই সঙ্গে রমজান মাসের ২৭ তারিখে লাইলাতুল কদরে দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমান ‘বায়তুল ইজ্জাত’ তথা ‘বায়তুল মামুরে’ অবতীর্ণ হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি এটি (কোরআন) কদরের রাত্রিতে নাজিল করেছি।’ (সূরা আল-কদর, আয়াত: ১) দ্বিতীয় পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ওহি হিসেবে কোরআন প্রয়োজনমতো বিভিন্ন ঘটনা ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নবুওয়াতের ২৩ বছর ধরে ধীরে ধীরে নাজিল হয়।
নবী করিম (সা.)-এর ৪০ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে রমজান মাসের ২৭ তারিখে ‘লাইলাতুল কদর’-এ হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকাকালে জিবরাইল (আ.)-এর মারফত আল্লাহর কাছ থেকে প্রত্যক্ষ অহিযোগে তাঁর ওপর সর্বপ্রথম ‘কোরআন’ অবতীর্ণ হয়। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.)-এর প্রতি সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে ওহি অবতরণের সূচনা হয়েছিল। অতঃপর তাঁর মধ্যে নির্জনে উপাসনা করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তখন তিনি হেরা গুহায় রজনীর পর রজনী আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন। এমতাবস্থায় রমজানের এক বিশেষ রজনীতে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) কর্তৃক তাঁর কাছে পাঁচটি আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়, ‘পড়ো! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে এঁটে থাকা বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ো! আর তোমার প্রতিপালকই সর্বাধিক সম্মানিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সূরা আল-আলাক, আয়াত: ১-৫) দশম হিজরিতে বিদায় হজের সময় আরাফাতের ময়দানে অবস্থানকালে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সর্বশেষ অহি হিসেবে অবতীর্ণ হয়, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম পূর্ণাঙ্গ করলাম আর তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩)
কোরআনের সঙ্গে রমজান মাসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা মাহে রমজানে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন এবং কদরের রাতকেই কোরআন নাজিলের জন্য বেছে নিয়েছেন। কোরআনে রয়েছে বিশ্বমানবতার জন্য চিরশান্তি ও মুক্তির মহান পয়গাম। কোরআন এমন এক শক্তিশালী নূর, যা কেউ কোনো দিন বিলীন করতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে কোরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা নিজেই গ্রহণ করে ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমিই কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী।’ (সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯)
মাহে রমজানের রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের জন্য দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক পূত-পবিত্রতা অর্জনের বাস্তবধর্মী প্রচেষ্টা কোরআন গবেষণা ও চর্চার মাধ্যমেই করা উচিত। তাহলেই কেবল রোজাদারদের মধ্যে মাহে রমজানের প্রকৃত শিক্ষা জাগ্রত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে কোরআন নিয়ে গবেষণা করতেন এবং মুখস্থ অংশ পুনরায় পড়তেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রমজানের প্রতি রাতে হজরত জিবরাইল (আ.) নবী করিম (সা.)-এর খেদমতে হাজির হতেন এবং তাঁরা উভয়ই কোরআন তিলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে রমজান মাসে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াতের জন্য আহ্বান করেছেন। মাহে রমজান কোরআন নাজিলের মাস হওয়ায় এ মাসকে সঠিকভাবে কোরআন তিলাওয়াতের মাস হিসেবে ধরে নিতে হবে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যদি কেউ আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ করার ইচ্ছা করে, তাহলে সে যেন কোরআন তিলাওয়াত করে।’ মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি অক্ষর পাঠ করে, সে একটি নেকি পায়, আর প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান।’ (তিরমিজি)
বাস্তবে মাহে রমজান হচ্ছে কোরআনের শিক্ষা অর্জন ও বিস্তারের মাস। রোজাদার ব্যক্তি রমজান মাসে খুব বেশি কোরআন তিলাওয়াত করেন। তাই রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন তার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রতিটি মাসেরই রয়েছে স্বতন্ত্র গৌরব ও মর্যাদা, আর মাহে রমজানের গৌরব ও অলংকার হচ্ছে রোজা ও কোরআন। এ দুইয়ের হক আদায়কারীদের জন্য রোজ হাশরে রোজা ও কোরআন আল্লাহর দরবারে শাফায়াত করবে। রোজা বলবে, ‘হে
আমার রব! আমি তাকে দিনে পানাহার ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রেখেছি, আমার তরফ থেকে তার জন্য শাফায়াত কবুল করুন।’ কোরআন বলবে, ‘হে আমার রব! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি, আমার তরফ থেকে তার জন্য শাফায়াত কবুল করুন।’ আল্লাহ তাদের সুপারিশ কবুল করবেন।’ (বায়হাকি, আহমাদ, তাবারানি ও হাকিম)
অতএব, রোজাদাররা যেন রোজা পালন ও কোরআনের মহিমাময় আদর্শের পরিপূর্ণ অনুশীলনের মাধ্যমে মাহে রমজানে প্রশিক্ষণ লাভ করতে পারেন এবং জীবন-দর্শন হিসেবে কোরআনের আলোকে নিজেদের স্বভাব-চরিত্র গঠন করতে পারেন, এ জন্য সবাইকে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হতে হবে। কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে নিজেদের প্রশিক্ষিত করার জন্য মাহে রমজানই উত্তম। তাই কোরআন নাজিলের রমজান মাসে সব ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কোরআনের মর্ম উপলব্ধি, তাফসির চর্চা ও শানে নজুল অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করা বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]