আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে ভূপৃষ্ঠে প্রভাব বিস্তার করার মতো বিবেক-বুদ্ধি, বিবেচনা, চিন্তাশক্তি ও জ্ঞান দান করেছেন। মানুষ শ্রেষ্ঠ, কারণ তাকে বিবেক দেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে সে ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচার করবে এবং অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুম-নির্যাতন থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। এই বিবেকের কারণে মানুষ পশুর থেকে পৃথক সত্তা। মানুষ যখন নিজের পশুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে সৎভাবে দৈনন্দিন জীবনযাপন করে, তখনই সে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই তো পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; তাদের উত্তম রিজিক দান করেছি এবং আমি যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৭০)
মানুষের জন্মলাভের পর যতই তার বয়স বৃদ্ধি পায়, ততই তার ভেতর প্রাণিজ বা পশুজ উপকরণ ও স্বভাব বাড়তে থাকে। শৈশবকালের পর যখন তার মেধা ও মস্তিষ্ক কার্যকর ও শক্তি লাভ করতে থাকে, তখন তার মধ্যে কল্পনাশক্তি বহু গুণে বেড়ে যায়। এ কল্পনাশক্তি ও পশুজ স্বভাব মিলে মানুষের ষড়্রিপুকে তৈরি ও বলবান করে, যার প্রধান আশ্রয় ও লালনকেন্দ্র হলো মানুষের নফস তথা নফসে আম্মারা। মানুষের পেশাদারি শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও সংস্কার নফসে আম্মারার আয়তন ও ক্ষমতা এত বাড়াতে পারে যে সে তখন নিজেকেই শুধু নয়, অন্যদেরও এমনকি বিভিন্ন জাতিকেও সিরাতুল মুস্তাকিমের মানবিক ঐশী পথ থেকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে।
মানুষের মধ্যকার পশুত্ব তখনই নিয়ন্ত্রণে আসে, যখন সে আল্লাহর দেওয়া তার অভ্যন্তরীণ বিবেক-বুদ্ধি এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে প্রদত্ত ইসলামি শরিয়তের বিধিবিধান অনুযায়ী পার্থিব জীবন পরিচালিত করে। এর বাইরে গেলেই সে শয়তানের কুমন্ত্রণায় অপশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পৃথিবীর নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয় এবং পরকালের অনন্ত জীবনে জাহান্নামের কীটরূপে কালপ্রবাহে পড়ে থাকবে। সমাজের একশ্রেণির বিবেকহীন লোকের মধ্যে আইনকানুন, নিয়মশৃঙ্খলা, রীতিনীতি, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদি না মানার অশুভ প্রবণতা বিরাজমান। এই সর্বগ্রাসী অনৈতিক প্রবণতার জন্য ভেঙে যাচ্ছে মানুষে মানুষে সুদৃঢ় সম্পর্কের নৈতিক চেতনাবোধ। একটা সমাজ যখন অন্যায় আর অনৈতিকতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন সেই সমাজে মূল্যবোধ মাটিতে গড়াগড়ি খায়। বিভিন্ন সভা-সমিতি, সেমিনার বা সিম্পোজিয়ামে শিশুশ্রম নিরসনসহ অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলা হলেও কেউ খোঁজ নিয়ে দেখে না দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গৃহকর্মী শিশুরা কতটা দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন ভোগ করে। কীভাবে তারা সামাজিক অবিচার ও অনাচারের বলি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। এসব নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় আমরা কতগুলো বিবেকহীন বিত্তবান মানুষের করতলগত হয়ে বসবাস করছি। নিজেদের লোভ-লালসার জন্য যারা নিষ্পাপ শিশুদের পাচার করে নরবলি দিতেও সামান্য দ্বিধাবোধ করে না। অথচ নবী করিম (সা.) সতর্কবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘নিজের কিংবা অন্যের কোনো ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না।’ (দারাকুতনি)
প্রতিটি মানুষই খেয়ে-পরে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য জীবনযুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তে তাকে লড়াই করতে হয়। কিন্তু বিবেক দ্বারা পরিচালিত না হয়ে এবং আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক জীবনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে না তুললে সে চতুষ্পদ জন্তুর চেয়ে অধম বা নিকৃষ্ট কোনো কিছুতে পরিণত হয়। এভাবে সমাজের সর্বক্ষেত্রে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় যখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে, তখন কারও পক্ষেই ভালো থাকার কথা নয়। বিবেকশূন্য পথভ্রষ্ট লোকদের হাত থেকে কেউ নিস্তার পায় না। তাই সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে নির্মম পৈশাচিক বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে দেশের নিষ্পাপ শিশু ও নারীরা। সমাজে নারী ও শিশুদের জীবনকে রক্ষা করতে হলে সবার আগে নিজেদের নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন ও ব্যক্তিত্বশালী ব্যক্তিতে পরিণত করতে হবে। প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় তুলে ধরে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ।’ (বুখারি ও মুসলিম)
দেশ-জাতি ও রাষ্ট্রের যেমন উচিত মানবাধিকার রক্ষাকল্পে বিভিন্ন আইনকানুন ও গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা, তেমনি করে দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্তব্য নিজেদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করে নারী ও শিশু নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা। তাহলেই অসহায় নারী ও শিশুরা মানবরূপী দানবদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ইসলামের মর্মবাণী অনুশীলনের দ্বারা ষড়্রিপু ও পশুত্ব নিয়ন্ত্রণের মধ্যে মানবজাতির মুক্তি নিহিত আছে। অমানবিকতা, হিংস্রতা, হিংসা-বিদ্বেষ, জিঘাংসা ও পরশ্রীকাতরতা মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা যেমন খারাপ ও নিকৃষ্ট স্বভাব, তেমনি ভালো কাজের মধ্যে রিয়া, যা বাহ্যিকভাবে লোক-দেখানোর জন্য হয়ে থাকে তা ভালো কাজের পুণ্য প্রাপ্তি বরবাদ করে দেয়। অথচ বিবেকবান মানুষ পারে না এমন কোনো সৎ কাজ নেই। স্থলে, জলে, জঙ্গলে প্রায় সব জায়গায় রয়েছে মানুষের পদচিহ্ন। মানুষ তার শ্রম, মেধা, ইচ্ছাশক্তি এবং বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই সব অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]