বরকতময় ও স্মৃতিবিজড়িত আখেরি চাহারশোম্বা

প্রিয় নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসা মুমিনের ইমান; সুন্নাতের অনুসরণই ভালোবাসার প্রমাণ। কোরআন করিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে রাসুল!) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো; ফলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে আমার সুন্নাতকে ভালোবাসে, সে অবশ্যই আমাকে ভালোবাসে; আর যে আমাকে ভালোবাসে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ (নাসায়ি)।

আখেরি চাহারশোম্বা প্রিয় নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসার প্রকাশ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেহ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মোমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার সন্তান অপেক্ষা, তার পিতা অপেক্ষা এবং সকল মানুষ অপেক্ষা বেশি প্রিয় হই।’ (বুখারি: ১৩-১৪)। তিনি আরও বলেন, ‘যে যাকে ভালোবাসবে, তার সঙ্গে তার হাশর-নশর হবে।’ (মুসলিম)। হাদিসে আরও রয়েছে, ‘সর্বোত্তম আমল হলো আল্লাহর জন্য ভালোবাসা।’ (আবু দাউদ)।

আল কোরআন ইসলামের মূল দর্শন, হাদিস বা সুন্নাহ কোরআনেরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ; সিরাত বা নবীজি (সা.)-এর জীবন কোরআন হাদিসের দর্পণ, ফিকাহ ইসলামি জীবন বিধানের সুবিন্যস্ত রূপ। একজন মোমিন বা বিশ্বাসী ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ মুসলিম তথা অনুগত বান্দা হিসেবে জীবনযাপনের জন্য কোরআন, সুন্নাহ, সিরাত ও ফিকাহ—এই চতুর্বিধ বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে হবে।

ধর্মীয় উপলক্ষগুলো শুধু দিবস পালনেই সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীজি (সা.)-এর আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণ করতে হবে। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মহব্বত করে ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে এবং আল্লাহর জন্য দান করে ও আল্লাহর জন্য বিরত থাকে; অবশ্যই তার ইমান পূর্ণ হলো।’ (আবু দাউদ: ৪০৬৪)।

নামাজ, রোজা, শবে বরাত, শবে কদর ও ফাতেহায়ে দোয়াজদহমের মতো ‘আখেরি চাহারশোম্বা’ কথাটিও ফারসি। ‘আখেরি’ মানে শেষ, ‘চাহারশোম্বা’ মানে বুধবার। ‘আখেরি চাহারশোম্বা মানে শেষ বুধবার। ইসলামের ইতিহাসে সফর মাসের শেষ বুধবার ‘আখেরি চাহারশোম্বা’ নামে পরিচিত। প্রসিদ্ধ মতে, এই দিনটি ছিল সফর মাসের ২৬ তারিখ। হজরত নবী করিম (সা.) দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষার্ধে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার দিন কিছুটা সুস্থ হয়ে গোসল করে কিছু পানাহার করে মসজিদে নববিতে গিয়ে নামাজের ইমামতি করেছিলেন। এতে উপস্থিত সাহাবিগণ এবং নবী পরিবারের সদস্যগণ যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) অসুস্থতা, অসুস্থতাকালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ ও তিরোধান ইত্যাদি বিশদভাবে বহু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সেই সব বর্ণনায় নির্দিষ্টভাবে দিন, তারিখ বা সময় পাওয়া যায় না। হিজরি দ্বিতীয় শতক থেকে তাবিয়ি ও তাবে-তাবিয়ি আলিমগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের ঘটনাবলি ঐতিহাসিক দিন-তারিখসহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন। তখন থেকে মুসলিম পণ্ডিতগণ এ বিষয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। তাই তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে বিভিন্ন মত হয়েছে। প্রখ্যাত তাবিয়ি ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রহ. (১৫১ হিজরি, ৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দ) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অসুস্থতায় ইন্তেকাল করেন, সে অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষ কয়েক দিন থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে। (আস-সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ইবনে হিশাম, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২৮১)।

বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের জীবনের প্রতিটি কাজই সবারই অনুকরণীয়। নবীজি (সা.)-এর জীবনের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিকগুলো এবং তাঁর অনুপম আদর্শ সামনে নিয়ে এলে তা বর্তমান সমাজ ও সভ্যতার জন্য পরম উপকারী হবে। মানুষ দুনিয়ার শান্তি ও পরকালে মুক্তির দিশা খুঁজে পাবে

প্রিয় নবীজি (সা.)-এর অসুস্থতা কী বারে শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন অসুস্থ থাকার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত হয়েছে; কেউ বলেছেন ১৩ দিন, ১৪ দিন বা ১৫ দিন অসুস্থ থাকার পর তিনি ইন্তেকাল করেছেন। অসুস্থ অবস্থাতেই ইন্তেকালের কয়েক দিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত ইমাম বুখারি (রা.) সংকলিত হাদিসেও তা উল্লেখ আছে। তবে কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল, তা হাদিসের বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। (ইমাম ইবনু হাজার আসকালানি, ফাতহুল বারি শরহু বুখারি, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ১৪১)।

বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের জীবনের প্রতিটি কাজই সবারই অনুকরণীয়। নবীজি (সা.)-এর জীবনের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিকগুলো এবং তাঁর অনুপম আদর্শ সামনে নিয়ে এলে তা বর্তমান সমাজ ও সভ্যতার জন্য পরম উপকারী হবে। মানুষ দুনিয়ার শান্তি ও পরকালে মুক্তির দিশা খুঁজে পাবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব

[email protected]