তিনি চিরপ্রশংসিত ‘মুহাম্মদ’। মুহাম্মদ নামটি কোরআন মজিদে চারবার রয়েছে। তিনি মহান প্রভুর সর্বাধিক প্রশংসাকারী ‘আহমাদ’। আহমাদ নামটি কোরআন কারিমে এসেছে একবার। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্মরণ করো, মারইয়াম–তনয় ঈসা (আ.) বলেছিল, “হে বনি ইসরাইল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসুল এবং আমার পূর্ব হতে তোমাদের নিকট যে তাওরাত রয়েছে, আমি তার সর্বাধিক সমর্থক এবং আমার পরে আহমাদ নামে যে রাসুল আসবেন, আমি তাঁর সুসংবাদদাতা।”’ (সুরা-৬১ সফ, আয়াত: ৬)। তাঁর শত–সহস্র গুণবাচক নামের একটি হলো মুয়াল্লিম, অর্থাৎ শিক্ষক। সত্যিই তিনি ছিলেন বিশ্বশিক্ষক। তিনি শিখিয়েছেন প্রেম-ভালোবাসা, শিখিয়েছেন ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য, শিখিয়েছেন মানুষের প্রতি মানুষের অধিকার ও কর্তব্য। সর্বোপরি আরও শিখিয়েছন ‘সৃষ্টির সেবা ও স্রষ্টার ইবাদত’।
তিনি এসেছেন প্রভাতে। সেই বর্বর যুগের পশুসুলভ জীবনাচার ও জুলুম, নিপীড়ন–নির্যাতনের সামাজিক অন্যায়–অবিচার ও অত্যাচারের তমসা থেকে মানবতাকে সভ্যতার আলোর দিকে এগিয়ে নিতে; তিনি ভোরের সমীরণপ্রবাহ সঙ্গে নিয়ে, প্রভাতরবির রক্তিম আভায়, সকালের সূর্যের হাসি হয়ে উষার আকাশে উদিত হলেন মুক্তির দূতরূপে।
শুক্লপক্ষে এলেন তিনি, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে। পুণ্যময় পূর্ণিমা শশীর পূর্ণ আলোক আভা নিয়ে আলোকিত করতে বিশ্বজগৎকে। দিন ছিল সোমবার। সপ্তাহের মধ্য দিবস, অতি তাত্পর্যময়। প্রতি সোমবার মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে করা হয় ইফতারের বিশেষ আয়োজন। নবী করিম (সা.) সোমবার রোজা পালন করতেন। সাহাবিরা জানতে চাইলেন, হুজুর, আপনি কেন প্রতি সোমবার রোজা পালন করেন? নবীজি (সা.) উত্তরে বললেন, ‘সোমবারেই আমার জন্ম হয়েছিল, তাই এই দিনে আমি রোজা পালন করে আল্লাহ তাআলার শোকরিয়া জ্ঞাপন করি।’ আজও মদিনাবাসী সপ্তাহে সোমবার রোজা পালন করে সেই আনন্দ উদ্যাপন করে থাকেন। এই সুন্নত আজও চলমান, থাকবে কিয়ামত অবধি।
হিজরি চান্দ্রবর্ষের আরবি তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল। রবি অর্থ বসন্তকাল, আউয়াল অর্থ প্রথম; রবিউল আউয়াল অর্থ প্রথম বসন্ত। রবিউস সানি মানে দ্বিতীয় বসন্ত বা বসন্তের দ্বিতীয় মাস। সেকালে আরব দেশে রবিউল আউয়াল ও রবিউস সানি এই দুই মাস মিলে ছিল বসন্তকাল। বসন্ত ঋতু হলো ঋতুরাজ। পত্রপল্লবে সুশোভিত হয় পরিবেশ, ফুলে–ফলে ভরে ওঠে প্রকৃতি। দখিনা হাওয়া বুলিয়ে দেয় শান্তির পরশ। এমনি এক মোহনীয় সময়ে জগদ্বাসীর জন্য প্রশান্তির বারতা নিয়ে এই মাটির পৃথিবীতে শুভাগমন করলেন—রাহমাতুল লিল আলামিন তথা সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত ও করুণার আকর মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। সঙ্গে নিয়ে এলেন সভ্যতার বসন্তকাল।
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ, আজ থেকে প্রায় ১৪৪৮ সৌরবর্ষ আগে জগৎগুরু হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই ধরাধামে আগমন করেন। তখন চলছিল আইয়ামে জাহেলিয়াত, মানে অন্ধকারের যুগ। অজ্ঞানতা, মূর্খতা, কুসংস্কার, দুর্নীতি ও পাপাচারে লিপ্ত ছিল জাজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপবাসী। এ সময় জ্ঞানের আলো নিয়ে, মুক্তির বাণী নিয়ে এলেন মানবতার মহান বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
সেই মহামানবের প্রশংসা কোরআন কারিমে ঘোষণা হয়েছে এভাবে, ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের নিকট এক রাসুল এসেছেন। তোমাদের যাহা বিপন্ন করে, উহা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। অতঃপর উহারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনি বলুন, “আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই। আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করি এবং তিনি মহা আরশের অধিপতি। ”’ (সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ১২৮-১২৯)। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) একজন রাসুল; তাঁর আগে বহু রাসুল গত হয়েছেন। সুতরাং যদি তিনি ইন্তেকাল করেন অথবা শাহাদতবরণ করেন, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেহ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না; বরং আল্লাহ শিগগিরই কৃতজ্ঞদিগকে পুরস্কৃত করবেন।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৪৪)। ‘মুহাম্মদ (সা.) তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নহেন; বরং তিনি আল্লাহর রাসুল এবং সর্বশেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৪০)। ‘মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল; তাঁর সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদিগকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবেন। তাদের লক্ষণ তাদের চেহারায় সিজদার প্রভাব পরিপূর্ণ থাকবে: তাওরাতে তাদের বর্ণনা এইরূপ এবং ইঞ্জিলেও তাদের বর্ণনা এইরূপই। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা হতে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর ইহা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কালের ওপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, যা চাষির জন্য আনন্দদায়ক। এইভাবে আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদিগকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের।’ (সুরা-৪৮ ফাত্হ, আয়াত: ২৯)। ‘যারা ইমান আনে, সৎকর্ম করে এবং মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস করে, আর উহাই তাদের প্রতিপালক হতে প্রেরিত সত্য, তিনি তাদের মন্দ কর্মগুলো বিদূরিত করবেন এবং তাদের অবস্থা ভালো করবেন।’ (সুরা-৪৭ মুহাম্মদ, আয়াত: ২)।
আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে তাঁর মহান বন্ধু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নানান অভিধায় অভিহিত করেছেন, বিভিন্ন বিশেষণে বিভূষিত করেছেন, বিবিধ সম্ভাষণে সম্বোধন করেছেন। আহ্বান করেছেন কখনো ‘তহা’, আবার কখনো ‘ইয়াসিন’। (সুরা-২০ তহা, আয়াত: ১; সুরা-৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ১)। এসবের মধ্যে পরিচিত তিনি ‘কামলিওয়ালা’ নবী তথা ‘মুজ্জাম্মিল’ ও ‘মুদ্দাছছির’। (সুরা-৭৩ মুজ্জাম্মিল, আয়াত: ১ ও সুরা-৭৪ মুদ্দাছছির, আয়াত: ১)। তিনিই চিরপ্রশংসিত হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]