জিকিরে চিত্তের প্রশান্তি

ধর্ম
ধর্ম

আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে রোজাদারের চিত্তের প্রশান্তি। দেহকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখার জন্য যেমন খাবার বা আহারের প্রয়োজন, তেমনি কল্ব বা রুহকে জীবিত রাখার জন্যও খাবারের প্রয়োজন হয়; আর রুহ বা কল্বের সেই খাবার হলো আল্লাহর জিকির। তাই আল্লাহর স্মরণ বা জিকির দ্বারা তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা প্রতিটি রোজাদার মানুষের ইমানি দায়িত্ব। ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং তোমরা আমাকেই স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫২)
বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণে সুদৃঢ় হয় বান্দার সঙ্গে স্রষ্টার প্রেমের বন্ধন। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘তিনি তাদের তাঁর পথ দেখান, যারা তাঁর অভিমুখী, যারা ইমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত-প্রশান্ত হয়। জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত-প্রশান্ত হয়।’ (সূরা রা’দ, আয়াত: ২৭-২৮)
রমজান মাসে রোজাদারেরা ভয় ও আশার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকেন, নিসাব পরিমাণ সম্পদশালীরা জাকাত-ফিতরা ও দান-সাদকা করতে থাকেন, আর্তপীড়িতদের সেবা করে ও নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দেন, মজলুম জনগণের পাশে দাঁড়ান, দুর্যোগের মুহূর্তে মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে যান এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনাদর্শকে নিজের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও ভীতিবিহ্বল চিত্তে অনুচ্চস্বরে প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ করবে এবং তুমি উদাসীন হবে না।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ২০৫)
একদা একজন সাহাবি আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাকে এমন একটা জিনিস শিক্ষা দিন, যার ওপর আমি রীতিমতো আমল করতে পারি।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর জিকির দ্বারা তোমার জিহ্বা যেন সব সময় তরতাজা থাকে।’ হজরত আবু দারদা (রা.) বলেন, ‘যাদের জিহ্বা আল্লাহর জিকিরের দ্বারা তরতাজা থাকবে, তারা হাসতে হাসতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ জিকির ছাড়া কল্ব জীবিত রাখা বা অন্তর প্রাণবন্ত রাখার আর কোনো দাওয়াই পৃথিবীতে নেই। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি জিনিসের মরিচা পরিষ্কার করার যন্ত্র আছে আর অন্তরের মরিচা পরিষ্কার করার যন্ত্র হলো আল্লাহর জিকির।’ (বায়হাকি)
মাহে রমজানে সুখে-শান্তিতে, অবসর ও আরামের সময় জিকির করতে থাকলে বিপদে-আপদে তা কাজে আসে। দিনে-রাতে, জলে-স্থলে, দেশে-বিদেশে, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতায়, সুস্থতা-অসুস্থতায়, হাঁটা-চলায়, কাজের ফাঁকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির রোজাদারের অন্তরে রাখা প্রয়োজন। জিকির অন্তরে শান্তি ও প্রশস্ততা আনয়ন করে, স্রষ্টার প্রতি মোহাব্বত পয়দা করে, মাগফিরাতের দরজা খুলে দেয়। গিবত, চোগলখুরি, মিথ্যাচারিতা, কটূক্তি, মন্দ কাজ ও বাজে কথা থেকে রোজাদারকে রক্ষা করে। জিকিরের দরুনই অন্তর সজীব ও উর্বর হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে ‘যে ব্যক্তি নীরবে বসে আল্লাহর জিকির করে ও তার চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে, আল্লাহ তাকে তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)

>যে রোজাদার ব্যক্তি সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর ওপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং তিনি আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, মাগরিফাত ও নাজাত লাভ থেকে বঞ্চিত হন না

রমজান মাসে কোরআন তিলাওয়াতে আল্লাহর স্মরণ মনে উৎপন্ন হয় এবং স্রষ্টার সঙ্গে অন্তরের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। কামনা-বাসনাপূর্ণ অন্তরে আল্লাহর জিকির বা স্মরণ স্থান পায় না। তাই ইন্দ্রিয়কে দমন, কামনা ও আকাঙ্ক্ষাকে খর্ব করার উদ্দেশ্যেই রোজা রাখা জরুরি। সব ইবাদতই আল্লাহর জিকির ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহর স্মরণ বা জিকির বিষণ্নতা দূর করে মানসিক উত্তেজনা কমায়, হতাশা দূর করে, দুশ্চিন্তামুক্ত রাখে এবং রোগ নিরাময় করে। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’—এ কালেমায়ে তাইয়েবা ইসলামের মূল ভিত্তি; আর আল্লাহর জিকির বা স্মরণই সব ইবাদতের প্রাণ। নামাজেরও একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহকে স্মরণ করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত: ৪৫)
রোজাদারের হৃৎপিণ্ডে ‘আল্লাহ’ শব্দটি প্রতিফলিত হয়ে সমস্ত দেহে-রক্তে সঞ্চালিত হয় এবং দেহকে রাখে সক্রিয়। যার জন্যই আল্লাহর জিকিরে অন্তর পরিতৃপ্ত হয় ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। যে ব্যক্তি বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করে, রমজান মাসে তার দোয়া অবশ্যই কবুল হয়ে থাকে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া হলো ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’। ‘সুবাহানাল্লাহ’ ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ কোনো কোনো বর্ণনায়, ‘লা হাওলা ওয়া লা কুওইয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’কেও এর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে। যা মনে মনে পড়া, প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পরে পড়া বা শয়নের পূর্বক্ষণে পড়া রমজান মাসে অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ। যে রোজাদার ব্যক্তি সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর ওপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং তিনি আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, মাগরিফাত ও নাজাত লাভ থেকে বঞ্চিত হন না। তাই প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের সব সময় অন্তরকে আল্লাহর জিকিরে মশগুল রাখা অবশ্যকর্তব্য।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]