নতুন খ্রিষ্টাব্দ কিংবা বঙ্গাব্দ এলেই বুঝতে পারি, আরও একটি বছর আমরা পার করে দিয়েছি। সপ্তাহ তিনেক আগে বাংলা বর্ষবরণে এপার বাংলা ও ওপার বাংলার ব্যস্ত সময় কেটেছে। তবে এই ব্যস্ততা কেবল নতুনকে সাদরে বরণের আনন্দের ব্যস্ততা। এই ব্যস্ততা আমাদের ঐতিহ্য উদযাপনের। এই আনন্দ না ফুরাতেই বছর ঘুরে আবারও ফিরে এল শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তথা বুদ্ধপূর্ণিমা। ২৫৬১ বুদ্ধ বর্ষকে বিদায় এবং ২৫৬২ নব বুদ্ধ বর্ষকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বিশ্ব বৌদ্ধরা। বাংলাদেশের বৌদ্ধরাও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বুদ্ধপূর্ণিমা উদ্যাপন করছে। মূলত রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ এবং বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্তি-এই ত্রিস্মৃতি-বিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমার বহুল পরিচিত নাম হলো বুদ্ধপূর্ণিমা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং পবিত্র দিন।
বুদ্ধপূর্ণিমা বৌদ্ধদের ধর্মীয় জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। তবে যাঁর জন্মের সঙ্গে সমগ্র মানবজাতি এবং জগতের কল্যাণ জড়িত ছিল, যাঁর বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির সঙ্গে মানুষের দুঃখমুক্তির পথের সন্ধান নিহিত ছিল, যাঁর অন্তর্ধানে মানবজাতি এবং জগতের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সেই মহামতি তথাগত গৌতম বুদ্ধের জীবন এবং বাণী থেকে আমরা কী শিক্ষা গ্রহণ করছি কিংবা আদৌ কোনো শিক্ষা গ্রহণ করছি কি না, তার পর্যালোচনাও আমাদের করতে হবে।
বুদ্ধপূর্ণিমা উদ্যাপন বলতে দিনটি উপলক্ষে বুদ্ধপূজা দান, সংঘদান, মোমবাতি এবং আগরবাতি প্রজ্বালন, নতুন নতুন পোশাক পরিধান কিংবা কোথাও একটি শোভাযাত্রা বের করা-এসবের মধ্যে বুদ্ধপূর্ণিমা উদ্যাপন আটকে থাকে। এর বাইরে আরও কিছু কর্মসূচি রাখা যায়, যেমন-স্বেচ্ছায় রক্তদান, হাসপাতালে গরিব ও দুস্থ রোগীদের মাঝে খাবার বিতরণ, অসহায়-দরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে বস্ত্র বিতরণসহ জনকল্যাণকর ইত্যাদি। অবশ্য কোনো কোনো স্থানে এসব কর্মসূচিও পালন করা হয়। তবে তা খুবই সীমিত।
পূজা এবং দান-দক্ষিণা এসবেরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু এর পাশাপাশি বুদ্ধের আবির্ভাব ও জগৎ কল্যাণ, বুদ্ধের জীবপ্রেমের শিক্ষা, অহিংসা ও সাম্যবাদ এবং বুদ্ধের ধর্মাভিযানে যে মানবতাবাদ ও গণতন্ত্রের সর্বজনীন শিক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে-এসব বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনার গুরুত্বও অনেক বেশি। আমরা বৌদ্ধরা বুদ্ধের পথে আছি কি না, বুদ্ধ নির্দেশিত এবং মনুষ্য জীবনের অলংকার সেই পঞ্চনীতি পালন করছি কি না, আমাদের প্রজন্ম বুদ্ধের অহিংস নীতি ও সাম্যবাদের শিক্ষায় বেড়ে উঠছে কি না-এসব বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হওয়া বৌদ্ধমাত্রেই গুরুদায়িত্ব এবং কর্তব্য বলে মনে করি। আমাদের প্রজন্ম বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষা এবং বুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারছে কি না, এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার কোনো বিকল্প নেই। একটি সুখী, যোগ্য, শান্তিপ্রিয়, মানবদরদি ও নৈতিক ভিতসম্পন্ন বৌদ্ধ প্রজন্ম এবং সমাজ গঠনে নতুন প্রজন্মকে বুদ্ধের শিক্ষা ও অহিংস নীতিমুখী করার বিকল্প নেই।
যিনি হৃদয়ে বুদ্ধকে ধারণ করবেন, তিনি কখনো জীব হত্যা, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যাচার এবং মাদক সেবন করবেন না। আজকে বিশ্বময় যে অস্থিরতা এবং অশান্তির দাবানল জ্বলছে, তা কেবল এই পঞ্চনীতির লঙ্ঘনজনিত কারণেই হচ্ছে। বুদ্ধের উদ্দেশে প্রতিদিন বিহারে বুদ্ধপূজা দান করতে হবে-এমন কথা বুদ্ধ ত্রিপিটকের কোথাও বলেননি। কিন্তু একজন বৌদ্ধ হিসেবে পঞ্চনীতি অক্ষুণ্নভাবে পালন করার প্রয়োজনীয়তা এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে বুদ্ধ বিস্তারিত বলেছেন। চতুরার্য সত্য এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা পথ অবলম্বনে জীবন ও জীবিকা নির্বাহের শিক্ষা বুদ্ধ দিয়েছেন।
বুদ্ধ বাহ্যিক আড়ম্বরতার চেয়ে মানসিক উৎকর্ষসাধনের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। বুদ্ধের শিক্ষা হলো, মানুষ জন্মের সঙ্গে কিছু বিকার বা রিপু নিয়ে জন্মায়। এগুলো হলো-লোভ, দ্বেষ বা হিংসা, মোহ, কাম, ক্রোধ এবং পরশ্রীকাতরতা স্বভাব ইত্যাদি। এসব রিপুর তাড়নায় মানুষ অন্যায় বা পাপকাজ করে। আবার এসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যহীন রিপুর উৎপত্তিস্থল হলো মানুষের চিত্ত বা মন। রিপু দমন এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হলে চিত্ত বা মনকে সংযম এবং বোঝার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কারণ, মানুষের চালিকাশক্তি হলো তার চিত্ত বা মন। চিত্তে যা উৎপন্ন হয় মানুষ কায়া বা দেহ দ্বারা তা সম্পাদন করে মাত্র। যার চিত্ত সংযত তার বাক্য ও কায়া সংযত হয়। অস্থির, কলুষিত এবং বিপথগামী চিত্ত কেবল অকুশল তথা বিপদের কারণ হয়ে থাকে। বিষে ভরা মনে কখনো কুশল বা ভালো চিন্তাধারা প্রবাহিত হতে পারে না। যিনি চিত্ত জয় করত পারেন, তিনিই আত্মজয় করতে পারেন।
বুদ্ধের মতে, ‘যুদ্ধে শত সহস্রজনকে জয় করার চেয়ে আত্মজয়ই শ্রেষ্ঠ জয়।’ স্বীয় চিত্তকে দমন করতে না পারলে আত্মজয় সহজ কাজ নয়। এটাই বুদ্ধের শিক্ষা। মানুষ হতে হলে আত্মকেন্দ্রিকতার খোলস থেকে বেরিয়ে সবার মঙ্গল এবং হিতের কথা ভাবতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে হৃদয় দিয়ে। মানুষকে বিচার করতে হবে কেবল মানুষ হিসেবে। সবার সুখে সুখী এবং সবার দুঃখে দুঃখী হতে হবে। কেবল ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ বলে মুখে আওড়ালে হবে না। এটা কেবল কথার কথা নয়। এটা একজন সম্যক সম্বুদ্ধের অসীম ত্যাগ এবং সাধনালব্ধ উপলব্ধির অন্তরের ডাক।
রোহিঙ্গা নিপীড়ন করে মিয়ানমারের নির্দয় শাসকগোষ্ঠী বুদ্ধের সেই অমৃত এবং অমিয় বাণীকে রক্তাক্ত করেছে। তাদের সহিংস ও জীবে প্রেমহীন এই নিষ্ঠুর পথ বুদ্ধের পথ নয়। তারা পথভ্রষ্ট, তারা হিংসায় উন্মত্ত। তারা মূলত ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ এই বাণী উচ্চারণেরও যোগ্যতা হারিয়েছে। নোবেল বিজয়ী বৌদ্ধধর্মীয় গুরু দালাই লামার মতে, ‘মানবিক এই সংকটে বুদ্ধ বেঁচে থাকলে রোহিঙ্গাদের পক্ষই নিতেন।’ আমরাও অত্যাচারীদের সঙ্গে নেই। আমরা মানবতার পক্ষে। আসুন, আমরা বুদ্ধের পথে চলি। তাহলে মানুষের ভেতরে থাকবে না কোনো অপরাধপ্রবণতা, পরিবার ও সমাজে থাকবে না কোনো অন্যায়, অবিচার, হিংসা, হানাহানি এবং রক্তপাত। আমরা গর্ব করে বলতে পারব, আমরা অহিংসবাদী জীবপ্রেমী বুদ্ধের অনুসারী। এটাই হোক এবারের বুদ্ধপূর্ণিমার দীপ্ত অঙ্গীকার।
জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সবাইকে জানাই শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমাবিহারের সহকারী পরিচালক