আরবি ‘আজহা’ শব্দের অর্থ কোরবানির নিয়তে জবাই অথবা কোরবানির পশু। আজহার আরেক অর্থ হলো ছাগল। এ কারণে ঈদুল আজহাকে ‘বকরি ঈদ’ও বলা হয়। কোরবানি অর্থ নৈকট্য, ত্যাগ–তিতিক্ষা। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য যেকোনো ত্যাগই হলো কোরবানি।
পরিভাষায় কোরবানি হলো জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সূর্যোদয় থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগপর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট জন্তু জবাই করা।
স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক (সাবালক) মুসলিম যদি কোরবানি ঈদের তিন দিন (১০ জিলহজ সকাল থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের অাগপর্যন্ত) সময়ের মধ্যে সাহেবে নিসাব (সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ ভরি রুপা অথবা এর যেকোনো একটির মূল্যের সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা ব্যবসার পণ্যের মালিক) থাকেন বা হন, তাঁর জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। কোরবানি শুধু এক আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হতে হবে, লৌকিকতা বা সামাজিকতার উদ্দেশ্যে নয়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু সমগ্র জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৬২)। ‘আল্লাহর কাছে ওদের গোশত–রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)।
ঈদের দিনের আমল হলো খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, ফজরের নামাজ মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করা, সকালে গোসল করা, মিসওয়াক করা, সম্ভব হলে নতুন জামা অথবা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করা, আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করা, ঈদগাহে এক রাস্তায় যাওয়া এবং অন্য রাস্তায় ফিরে আসা, আসা-যাওয়ার সময় তকবির (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ) বলা, খোলা মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করা।
কোরবানির পশু মুসলমান নারী ও পুরুষ সবাই জবাই করতে পারেন। নিজের কোরবানির পশু নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে জবাই করতে না পারলে যেকোনো কাউকে দিয়ে জবাই করাতে পারেন। জবাইয়ের সময় নিজে উপস্থিত থাকতে পারলে ভালো।
আকিকা: গরু, মহিষ বা উটে অংশ হিসেবে যেভাবে কোরবানি দেওয়া যায়; সেভাবে একটিকে সাতটি ধরে অংশ হারে আকিকাও করা যায়। কোরবানি ও আকিকা একসঙ্গে করতে কোনো বাধা নেই।
ওয়াজিব ও নফল কোরবানির গোশত খাওয়া যায় এবং খাওয়ানো যায়; এটি সবাই খেতে পারেন। উত্তম হলো কোরবানির গোশত সম্ভব হলে তিন খাতে বণ্টন করা। আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া, গরিব পাড়া–প্রতিবেশীদের দেওয়া এবং নিজ পরিবারের জন্য রাখা। (তিরমিজি)।
যদি একাধিকজন একটি পশুতে শরিকে কোরবানি করেন; তবে প্রথমে প্রত্যেকের অংশ আনুপাতিক হারে সমবণ্টনে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। খুশিমনে কেউ কম নিলে বা কাউকে নিজের থেকে বেশি দিলে দোষ নেই। সব অংশীদার একমত হলে গরিবদের জন্য যতটুকু ইচ্ছা রেখে দিতে পারেন। তবে যাঁর যাঁর অংশ থেকে যাঁর যাঁর মতো আলাদা দেওয়া উত্তম ও নিরাপদ। কারণ, সবার প্রয়োজন সমান নয় এবং সবার মানসিকতা এক নয়।
ওয়াজিব কোরবানি ছাড়া ছোট–বড় জীবিত–মৃত যেকোনো কারও পক্ষ থেকে যেকোনো কেউ নফল কোরবানি আদায় করতে পারেন। এতে উভয়েই সওয়াবের অধিকারী হবেন। নারী যদি সামর্থ্যবান বা সাহেবে নিসাব হন, তাঁর জন্যও কোরবানি ওয়াজিব। শিশুদের ওপর কোরবানিসহ কোনো ফরজ–ওয়াজিব প্রযোজ্য নয়।
কোরবানির গোশত প্রয়োজনে যত দিন খুশি রাখা যায়। তবে যে সমাজে আমিষের অভাবে মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভোগে, অনেকের গোশত কেনার সামর্থ্য নেই, এমতাবস্থায় কোরবানির গোশত পুঞ্জীভূত করে রাখা অনৈতিক ও অমানবিক। তবে বিশেষ কোনো ব্যক্তির জন্য বা শখের বশে অল্প পরিমাণে রাখলে তাতে কোনো দোষ নেই।
কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তথা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ফরজ ইবাদত। তাই যত্রতত্র রাস্তাঘাটে–পথের ধারে কোরবানির পশু জবাই করা যাবে না। নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাইয়ের পর মলমূত্র, রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং বর্জ্য মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে বা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ আমল।
পশু কোরবানির পাশাপাশি নিজের মনের পশু তথা নফস আম্মারাকে কোরবানি করে (আত্মত্যাগের মাধ্যমে) পরিশুদ্ধ করা এবং আল্লাহর কাছে সর্বাত্মকভাবে আত্মসমর্পণ করাই কোরবানি মূল দর্শন ও প্রকৃত শিক্ষা।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম