রাজা হিরাক্লিয়াসের ঘটনা
হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.)-এর বরাতে এই হাদিসের বর্ণনা আছে।
রাজা হিরাক্লিয়াস একবার তাঁর কাছে লোক পাঠালেন। তিনি সে সময় ব্যবসা উপলক্ষে কুরাইশদের কাফেলায় সিরিয়ায় ছিলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তখন আবু সুফিয়ান ও কুরাইশদের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হুদায়বিয়ার সন্ধিতে চুক্তিবদ্ধ।
হিরাক্লিয়াস ছিলেন জেরুজালেমে। আবু সুফিয়ান তাঁর সঙ্গীসাথীসহ হিরাক্লিয়াসের কাছে এলেন। হিরাক্লিয়াস তাঁদের ডেকে পাঠালেন। রোমের স্থানীয় নেতারাও সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের ডেকে দোভাষীকে আনালেন। এর পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘যে মানুষটি নিজেকে নবী বলে দাবি করছে, তোমাদের মধ্যে বংশের দিক থেকে তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় কে?’
আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমি বললাম, বংশের দিক থেকে আমিই তাঁর নিকটাত্মীয়।’
তিনি বললেন, ‘উনাকে আমার একেবারে কাছে নিয়ে এসো। তাঁর সঙ্গীসাথীদেরও তাঁর পেছনে বসিয়ে দাও।’ এর পর তাঁর দোভাষীকে বললেন, ‘ওদের বলে দাও, আমি তাঁর কাছ থেকে ওই মানুষটি সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করব। যদি সে আমাকে মিথ্যা বলে, সঙ্গে সঙ্গে তোমরা তাকে মিথ্যুক বলবে।’ আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করবে, এই লজ্জা যদি আমার না থাকত তাহলে অবশ্যই আমি তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম।’ তিনি তাঁর (নবী) সম্পর্কে আমাকে প্রথম প্রশ্ন করলেন, ‘বংশমর্যাদার দিক থেকে তোমাদের মধ্যে তিনি কেমন?’ আমি বললাম, ‘তিনি আমাদের মধ্যে খুব সম্ভ্রান্ত বংশের।’ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এর আগে আর কখনো কি কেউ এমন কথা বলেছে?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে কেউ কি বাদশাহ ছিলেন?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘সম্ভ্রান্ত মর্যাদাবান শ্রেণির লোকেরা কি তাঁকে অনুসরণ করে, নাকি দুর্বলেরা?’ আমি বললাম, ‘দুর্বলেরা।’ তিনি বললেন, ‘তাদের সংখ্যা কি বাড়ছে, না কমছে?’ আমি বললাম, ‘তারা বেড়েই চলেছে।’ তিনি বললেন, ‘তাঁর ধর্মে ঢুকে কেউ কি অসন্তুষ্ট হয়ে সেটা ত্যাগ করে?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘তার দাবি তোলার আগে তোমরা কি কখনো তাঁকে মিথ্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছ?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘তিনি কি কখনো সন্ধিভঙ্গ করেছেন?’ আমি বললাম, ‘না। তবে আমরা তাঁর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময়ের সন্ধিতে আবদ্ধ আছি। জানি না, এর মধ্যে তিনি কী করবেন।’ আবু সুফিয়ান বলেন, ‘এ কথাটি ছাড়া নিজের দিক থেকে আর কোনো কথা যোগ করার সুযোগই আমি পাইনি।’ তিনি বললেন, ‘তোমরা তাঁর সঙ্গে কখনো যুদ্ধ করেছ কি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘তাঁর সঙ্গে তোমাদের যুদ্ধের পরিণাম কী হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘তাঁর আর আমাদের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফল কুয়ার বালতির মতো। কখনো তাঁর পক্ষে যায়, আবার কখনো আমাদের পক্ষে আসে।’ তিনি বললেন, ‘তিনি তোমাদের কী আদেশ দেন?’ আমি বললাম, ‘তিনি বলেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুর অংশীদার কোরো না, আর তোমাদের পূর্বপুরুষেরা যা বলে, তা ত্যাগ করো। এ ছাড়া তিনি আমাদের সালাত আদায়ের, সত্য বলার, চারিত্রিক নিষ্কলুষতার এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দেন।’ এর পর তিনি দোভাষীকে বললেন, ‘তুমি তাকে বলো, আমি তোমার কাছে তাঁর বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। তুমি তার জবাবে বলেছ যে তিনি তোমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশের। প্রকৃতপক্ষে রাসুলদের তাঁদের সম্প্রদায়ের উচ্চবংশেই পাঠানো হয়ে থাকে। তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, এ কথা তোমাদের মধ্যে এর আগে আর কেউ বলেছে কি না? তুমি বলেছ, না।
তাই আমি বলছি, আগে যদি কেউ এমন কথা বলত, তবে আমি অবশ্যই বলতাম, ইনি এমন একজন লোক, যিনি তাঁর পূর্বসূরীদেরই অনুসরণ করছেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে কোনো বাদশাহ ছিলেন কিনা? তুমি তার জবাবে বলেছ, না। তাই আমি বলছি যে তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে কোনো বাদশাহ থাকলে আমি বলতাম, ইনি এমন এক লোক, যিনি তাঁর বাপ-দাদার বাদশাহি ফিরে পেতে চান। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, এর আগে কখনো তোমরা তাঁকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছ কিনা? তুমি বলেছ, না। এতে বুঝতে পেরেছি, এমনটি হতে পারে না যে কেউ মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা ত্যাগ করবে আর আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, সম্ভ্রান্ত লোকেরা তাঁর অনুসরণ করে নাকি সাধারণ লোক? তুমি বলেছ, সাধারণ লোকই তাঁকে অনুসরণ করে। আর বাস্তবেও এই শ্রেণির লোকেরাই হন রাসুলদের অনুসারী। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা সংখ্যায় বাড়ছে না কমছে? তুমি বলেছ, বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে ইমানে পূর্ণতা লাভ করা পর্যন্ত এ রকমই হয়ে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর ধর্মে প্রবেশ করে কেউ কি অসন্তুষ্ট হয়ে তা ত্যাগ করে? তুমি বলেছ, না। ইমানের স্নিগ্ধতা অন্তরের সঙ্গে মিশে গেলে ইমান এ রকমই হয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি সন্ধিভঙ্গ করেন কি না? তুমি বলেছ, না। প্রকৃতপক্ষে রাসুল এ রকমই, কখনো সন্ধিভঙ্গ করেন না। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি তোমাদের কী আদেশ দেন? তুমি বলেছ, তিনি তোমাদের এক আল্লাহর প্রার্থনা করা এবং তাঁর সঙ্গে অন্য কিছুর অংশীদারী না করার নির্দেশ দেন।
তিনি তোমাদের নিষেধ করেন মূর্তিপূজা করতে, আদেশ করেন সালাত আদায় করতে, সত্য বলতে এবং সচ্চরিত্র থাকতে। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে শিগগিরই তিনি আমার এ দুই পায়ের নিচের জায়গার অধিকারী হবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তাঁর আবির্ভাব হবে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্য হতে কেউ হবেন, তা আমি ভাবতে পারিনি। যদি জানতাম, আমি তাঁর কাছে যেতে পারব, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আমি যেকোনো কষ্ট সহ্য করে নিতাম। আর আমি যদি তাঁর কাছে থাকতাম, তবে অবশ্যই তাঁর পা দুটি ধুয়ে দিতাম। এর পর তিনি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সেই চিঠিটি দেওয়ার নির্দেশ দিলেন, যা তিনি দিহ্ইয়াতুল কালবী (রা.)-কে দিয়ে বসরার শাসকের মাধ্যমে হিরাক্লিয়াসের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সেটি পড়লেন। তাতে (লেখা) ছিল: ‘পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। শান্তি (বর্ষিত হোক) তার প্রতি, যিনি হিদায়াত অনুসরণ করেন। আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকুন। আল্লাহ আপনাকে দুইগুণ প্রতিদান দান করবেন। যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তবে সব প্রজার পাপই আপনার ওপর বর্তাবে। ‘হে আহলে কিতাব! সে কথায় আসুন যা আমাদের আর আপনাদের মধ্যে এক ও অভিন্ন। তা হলো আমরা যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও প্রার্থনা না করি, কোনো কিছুকেই যেন তাঁর শরিক না করি, আর আমাদের কেউ যেন কাউকে পালনকর্তা হিসেবে গ্রহণ না করে আল্লাহকে ত্যাগ করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমরা বলো, তোমরা সাক্ষী থাকো, আমরা তো মুসলিম।’ (সুরাহ আলে-ইমরান, ৩/৬৪) আবু সুফিয়ান বলেন, ‘হিরাক্লিয়াস যখন তাঁর বক্তব্য আর চিঠি পড়া শেষ করলেন, তখন সেখানে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। চিৎকার ও হইহল্লা চরমে পৌঁছাল। আমাদের তখন বের করে দেওয়া হলো। আমাদের বের করে দিলে আমি আমার সাথীদের বললাম, আবু কাবশার ছেলের বিষয় তো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বনু আসফার (রোম)-এর বাদশাহও তাকে ভয় পাচ্ছে! তখন থেকে আমি বিশ্বাস রাখতাম, তিনি শিগগিরই জয়ী হবেন। অবশেষে আল্লাহ–তাআলা আমাকে ইসলাম গ্রহণের তৌফিক দান করলেন।’ ইবনু নাতুর ছিলেন জেরুজালেমের শাসনকর্তা, হিরাক্লিয়াসের বন্ধু এবং সিরিয়ার খ্রিষ্টানদের পাদরি। তিনি বলেন, হিরাক্লিয়াস যখন জেরুজালেম আসেন, তখন একদিন তাঁকে অত্যন্ত বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তাঁর একজন বিশিষ্ট সহচর বলল, আপনার চেহারা আজ এত মলিন দেখছি? ইবনু নাতুর বলেন, হিরাক্লিয়াস ছিলেন জ্যোতির্বিদ। জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর দক্ষতা ছিল। তাদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘আজ রাতে আমি তারকারাজির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, খতনাকারীদের বাদশাহ আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান যুগে কোন জাতি খতনা করে?’ তারা বলল, ‘ইহুদি জাতি ছাড়া কেউ খতনা করে না। কিন্তু তাদের ব্যাপারে আপনি মোটেও চিন্তিত হবেন না। আপনার রাজ্যের শহরগুলোতে লিখে পাঠান, তারা যেন সেখানকার সব ইহুদিকে হত্যা করে ফেলে।’ তারা যখন এ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিল, তখন হিরাক্লিয়াসের কাছে এক লোককে হাজির করা হলো। সে আল্লাহর রাসুল (সা.) সম্পর্কে খবর দিচ্ছিল। হিরাক্লিয়াস তার কাছ থেকে খবর জেনে নিয়ে বললেন, তোমরা একে নিয়ে গিয়ে দেখ, তার খতনা হয়েছে কি না। তারা তাকে নিয়ে গিয়ে দেখে এসে জানাল, তার খতনা হয়েছে। হিরাক্লিয়াস তাকে আরবদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে জওয়াব দিল, তারা খাতনা করে।
হিরাক্লিয়াস তাদের বললেন, ইনি আল্লাহর রাসুল( সা.), এই উম্মতের বাদশাহ। তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। এর পর হিরাক্লিয়াস রোমে তাঁর এক বন্ধুর কাছে লিখলেন। তিনি জ্ঞানে তাঁর সমকক্ষ ছিলেন। পরে হিরাক্লিয়াস হিমস চলে গেলেন। হিমসে থাকতেই তাঁর কাছে বন্ধুর চিঠি এল, যা নবী (সা.)-এর আবির্ভাব, তিনিই যে প্রকৃত নবী—এ ব্যাপারে হিরাক্লিয়াসের মতকে সমর্থন করছিল। হিরাক্লিয়াস তাঁর হিমসের প্রাসাদে রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ডাকলেন। প্রাসাদের সব দরজা বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হলে দরজা বন্ধ করা হলো। তিনি সামনে এসে বললেন, হে রোমের অধিবাসী, তোমরা কি মঙ্গল, হিদায়াত আর তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহলে এই নবীর বায়াত গ্রহণ করো। এ কথা শুনে তারা বুনো গর্দভের মতো দ্রুত নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে দরজার দিকে ছুটল। কিন্তু দেখতে পেল, দরজা বন্ধ। হিরাক্লিয়াস তাদের অনীহা লক্ষ করে তাদের ইমান থেকে নিরাশ হয়ে বললেন, ‘ওদের আমার কাছে ফিরিয়ে আনো।’ তিনি বললেন, ‘আমি একটু আগে যা বলেছি, তা দিয়ে পরীক্ষা করলাম তোমরা তোমাদের ধর্মে কতটা অটল। এখন সেটা বুঝে নিলাম।’ এ কথা শুনে তারা তাঁকে সিজদা করল। তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হলো। এটাই ছিল হিরাক্লিয়াসের সর্বশেষ অবস্থা। বুখারি, হাদিস: ৭