দ্বিতীয় মানবসভ্যতার নবী নুহ (আ.)-এর ছেলে ছিলেন সাম। হজরত সালেহ (আ.) ছিলেন সামের বংশধর। তিনি সামুদ জাতির নবী। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত ওয়াদিউল কোরা প্রান্তরে ছিল তাঁদের বসতি, বর্তমানে লোকে যাকে চেনে ‘ফাজ্জুহ নাকাহ’ বা ‘মাদায়েনে সালেহ’ নামে। আরবের বিখ্যাত ঐতিহাসিক মাসউদি বলেন, ‘সিরিয়া থেকে হিজাজে যাওয়ার পথে সামুদ সম্প্রদায়ের ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতিগুলোর ভগ্নাবশেষ এবং তার প্রাচীন চিহ্নগুলো দেখা যায়।’ (কাসাসুল কোরআন, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড ১, পৃ ১২৮)
বেশ সচ্ছল ও অবস্থাপন্ন ছিল সামুদ জাতি। অর্থে স্বাবলম্বী ও শক্তিতে বলীয়ান ছিল। তাদের সুখ-শান্তির কমতি ছিল না। পাথর খোদাই ও স্থাপত্যবিদ্যায় তাদের বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। বড় বড় প্রাসাদ ও পাহাড় কেটে দালানকোঠা বানাত তারা। কারুকার্য ও নকশা করে পাথর দিয়ে সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করত। তাদের ছিল সবুজ-শ্যামল উদ্যান। সোনা-রুপার প্রাচুর্যে মোড়ানো জীবন। কিন্তু তারা আল্লাহকে মানত না। আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার করত। বহু উপাস্যের আরাধনা করত। মূর্তিপূজা করত। তাদের গোত্রের লোক সালেহ (আ.)। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত, বিচক্ষণ, সুবক্তা ও পণ্ডিত ব্যক্তি।
একদিন তিনি আল্লাহর নবী হয়ে তাদের কাছে গেলেন। তাদের একাত্মবাদের পথে আহ্বান করলেন। বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো উপাসক নেই, তিনিই তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাতেই তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কাজেই তাঁর কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো, আর তাঁর দিকেই ফিরে এসো, আমার প্রতিপালক তো অতি কাছে, আর তিনি ডাকে সাড়া দানকারী।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬১)
দুর্বল ও নগণ্য গুটিকয়েকজন ছাড়া কেউ তাঁর ডাকা সাড়া দিল না। সতর্কবার্তাও এড়িয়ে গেল। তারা প্রাসাদ, অর্থবৈভব ও বিলাসসামগ্রী নিয়ে গর্ব-অহংকার করল। বলল, নবী হলে তো আমরা হব, সালেহ কেন হবে? পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমাদের মধ্য থেকে কি তার ওপরই কোরআন নাজিল হলো?’ (আমরা বিদ্যমান থাকতেও কি এই লোকটির ওপর আল্লাহর নসিহতগুলো নাজিল হলো?) (সুরা সাদ, আয়াত: ৮)
তারা সালেহ (আ.)-এর কাছে নবী হওয়ার দলিল চাইল। তারা দাবি করল, আপনি যদি বাস্তবিকই আল্লাহর রাসুল হন, তাহলে আমাদের কাতেবা নামের পাথরময় পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি ১০ মাসের গর্ভবতী, সবল ও স্বাস্থ্যবতী উট বের করে দেখান। সালেহ (আ.) তাদের থেকে ইমান আনার প্রতিশ্রুতি নিলেন। তারা প্রতিশ্রুতি দিল। সালেহ (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহ তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন। গর্ভবতী ও দুগ্ধবতী উট বেরিয়ে এল পাথরময় পাহাড় থেকে। কোরআনে এটিকে ‘আল্লাহর উট’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ বিস্ময়কর মোজেজা দেখে কিছু লোক তৎক্ষণাৎ ইমান আনল। অন্যরা ইমান আনতে চাইলে পুরোহিতরা বাধা দিল।
সালেহ (আ.) তাদের উটের ব্যাপারে সতর্ক করলেন। এটিকে কষ্ট দিতে নিষেধ করলেন। বললেন, ‘আল্লাহর এই উটটি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন। অতএব তাকে আল্লাহর জমিনে বিচরণ করতে দাও এবং তাকে মন্দভাবে স্পর্শও করো না। নতুবা অতিসত্বর তোমাদের আজাব পাকড়াও করবে।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬৪)
একই কূপ থেকে উটনী ও অন্য জন্তুদের পানি পান করাত তারা। উটনী পানি পান করলে পানি শেষ হয়ে যেত। সালেহ (আ.) উটনীর জন্য একদিন ও তাদের জন্য একদিন নির্ধারণ করে দিলেন। অনেকেই সালেহ (আ.)-এর কথা মেনে নিল। এভাবে কিছুদিন চলল। তারা উটনী ও তার বাচ্চাদের থেকে উপকৃত হলো। এর মধ্যে তারা পানি নিয়ে উটনীর দিনটাকে ঝামেলা মনে করল। উটনীকে হত্যা করতে ফন্দি আঁটল। একপর্যায়ে সামুদ জাতির ‘মিসদা’ ও ‘কাসার’ নামের দুই যুবক বিভিন্ন প্রলোভনের নেশায় মত্ত হয়ে এই উটনীকে হত্যা করে। (কাসাসুল কোরআন, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড ১, পৃ ১৪৪-১৪৫)
আল্লাহ–তায়ালা সে অবস্থার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘অতঃপর তারা উটনীকে হত্যা করল এবং স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল। তারা বলল, হে সালেহ, নিয়ে এসো যা দিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে, তুমি যদি রাসুল হয়ে থাকো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৭৭)
সালেহ (আ.) উটনী হত্যার কথা শুনে লোকদের কাছে গেলেন। আজাবের দিনক্ষণ জানিয়ে দিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘তারা ওকে মেরে ফেলল, তখন সে (সালেহ) বলল, তোমরা নিজেদের ঘরে আরও তিন দিন বাস করে নাও; এটি ওয়াদা, যাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা নেই।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬৫)
প্রথম দিন তাদের সবার মুখমণ্ডল হলদে ফ্যাকাসে, দ্বিতীয় দিন লাল এবং তৃতীয় দিন ঘোর কালো হয়ে গেল। এক শনিবার ভোরে গগনবিদারী গর্জন, মুহুর্মুহু বিজলির চমক আর ভয়াবহ ভূমিকম্পে তাদের মৃত্যু হলো। তারা নিজ নিজ ঘরে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর পাকড়াও করল তাদেরকে ভূমিকম্প। ফলে সকালবেলায় নিজ নিজ ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৭৮)
আবু আশফাক মুহাম্মাদ: লেখক ও আলেম