স্পর্শ করো না

পুণ্যবানদের জীবনে সুরা মায়িদা কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল, সে সম্পর্কে অনেক গল্প ও হাদিস আছে। সবার সঙ্গে ভাগ করে নিই। অনেক সময় দেখা যায় যে ধার্মিক পূর্বসূরিরা তেমন ধার্মিক পটভূমি থেকে আসেননি। তাঁদের জীবন ছিল কঠিন: তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন মদ্যপানকারী, কেউবা ব্যভিচারী, আবার কেউ কেউ তাঁদের জীবনের কোনো একপর্যায়ে ডাকাত ছিলেন।

আজ যাঁর সম্পর্কে বলতে যাচ্ছি তিনি ছিলেন সেই সময়ের রাজপথের এক বিখ্যাত ডাকাত, তাঁর নাম আলী ইবনে আসাদি । তিনি ক্রমাগত চুরি করতেন, মানুষকে কষ্ট দিতেন, এবং তিনি ছিলেন মদিনার একজন দাগি আসামি। মদিনাবাসী তাঁর মাথার বিনিময়ে মুক্তিপণ দাবি করেছিল এবং সবাই তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। সমাজের এতটাই ক্ষতিসাধন তিনি করেছিলেন যে সবাই তাঁকে সমাজ থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল।

আরও পড়ুন

আলী ইবনে আসাদি একদিন ডাকাতির উদ্দেশ্যে হাঁটছিলেন এবং তিনি শুনতে পেলেন কেউ একজন সুরা যুমার–এর ৫৩ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করছেন। যদিও আয়াতটি আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, তিনি এই বিখ্যাত আয়াটি শুনলেন—বলো, ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’

আলী ইবনে আসাদি যখন লোকটিকে এই আয়াতটি তিলাওয়াত করতে শুনলেন, তিনি মনে মনে ভাবলেন: আমি যত খারাপই হই না কেন, আমার এখনো সুযোগ আছে। আমি এখনো আল্লাহর কাছে ফিরে আসতে পারি। অতঃপর তিনি কাঁদতে থাকলেন এবং আন্তরিকভাবে তাওবা করলেন।

আরও পড়ুন

তিনি রাসুলের (সা.) মসজিদে ছুটে গেলেন এবং সেখানে আবু হুরায়রাহকে (রা.) দেখতে পেলেন। তিনি তাকে জড়িয়ে ধরলেন, এবং বললেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে ফিরে এসেছি, আমি তওবা করেছি, আমি আর কখনোই ডাকাতি বা এ–জাতীয় খারাপ কোনো কাজ করব না।’

যখন তিনি মসজিদে আসেন, আবু হুরায়রাহকে (রা.) আলিঙ্গন করেন এবং নামাজ পড়তে শুরু করেন, সবাই তখন তাকে আক্রমণ করার জন্য তার কাছাকাছি আসতে শুরু করে। কারণ, তিনি তখন মদিনার মোস্ট ওয়ান্টেড। তিনি বলেন, ‘আপনারা আমাকে স্পর্শ করতে পারবেন না, কারণ আল্লাহ সুরা মায়িদার ৩৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন: (তবে এ শাস্তি) তাদের জন্য নয় যারা তোমাদের আয়ত্তে আসার আগে তাওবা করবে। জেনে রেখো, আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ [৫: ৩৪]

আরও পড়ুন

তাই আলী ইবনে আসাদি বলেন, এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন যে যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো অপরাধ করে, যার জন্য শাস্তির প্রয়োজন হয়, এবং যদি সে ধরা পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তওবা করে তাহলে আল্লাহ পরম করুণাময় এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল। এই আয়াতটি আমাদের ইসলামের রহমত সম্পর্কে ভাবতে শেখায়।

যখন আলী ইবনে আসাদি এই আয়াতের উদ্ধৃতি দিলেন, আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন: তিনি সত্য বলেছেন, এবং আবু হুরায়রাহ (রা.) তাঁর হাত ধরে তাঁকে মদিনার তৎকালীন মুয়াবিয়া খিলাফার আমির মারওয়ান ইবনে আল হাকামের কাছে নিয়ে গেলেন। আবু হুরায়রাহ বলেন, এই সেই যুবক আলী ইবনে আসাদি, যার ওপর মুক্তিপণ রয়েছে এবং আল্লাহ তাকে শাস্তির জন্য আনার আগেই তিনি আল্লাহর কাছে এসেছেন। সুবহানাল্লাহ, তিনিই প্রথমে তওবা করে আল্লাহর কাছে এসেছেন, তাই তাকে ক্ষমা করে দিন। তাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার কারও নেই, কারণ তিনিই আল্লাহর কাছে তওবা করে ফিরে এসেছেন।

আরও পড়ুন

এ ঘটনা থেকে আমরা ইসলামের করুণা এবং রহমত উপলব্ধি করতে পারি। এই ধর্মের উদ্দেশ্য কিন্তু মানুষকে শাস্তি দেওয়া নয়, বরং সমাজকে এবং সমাজের প্রতিটি মানুষকে রক্ষা করাই এর মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। কাজেই একজন পাপী যদি নিজের পাপ উপলব্ধি করে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করে, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ সমাজকে নির্দেশ দিয়েছেন সেই ব্যক্তির প্রতি সহনশীল এবং করুণাময় হওয়ার জন্য। এ ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো—আপনি যদি অনেক বড় পাপী হন, সম্ভবত আপনি রাজপথের ডাকাত নন, আপনারও সুযোগ আছে আল্লাহর কাছে ফিরে আসার।

কাজেই সমাজের করণীয় এখানে কী? একজন মানুষ যত খারাপই হোক না কেন সে যখন আল্লাহর ঘর মসজিদে আসে, তার মানে এখনো তার মধ্যে ভালো কিছু অবশিষ্ট আছে। একটি সমাজ এবং সম্প্রদায় হিসেবে আমাদের উচিত তাকে দূরে সরিয়ে না দিয়ে তার প্রত্যাবর্তনকে সুগম করা। এ ক্ষেত্রে সমাজের কিন্তু উচিত নয় তাকে তাড়িয়ে দেওয়া বা মসজিদ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। আর এটাই হলো সুরা মায়েদার ৩৪ নম্বর আয়াতের শিক্ষা।

আরও পড়ুন

আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যাঁরা আন্তরিকভাবে তাঁর কাছে তওবা করেন, তাঁর দিকে ফিরে আসেন এবং তাঁর অনুকূল সাহচর্যে নিজেদের খুঁজে পান, যাঁদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদের তওবাকারীদের মধ্যে উন্নীত করেন। আমরা আশা করি, আল্লাহ এইসুরার মাধ্যমে, আমাদের মর্যাদাকে উন্নীত করবেন এবং আমাদের কোরআনের মানুষে পরিণত করবেন।

অনুবাদ: ফাহমিনা হাসানাত

আরও পড়ুন