কোরাইশরা রাসুলে করিমের (সা.) কোরআন পাঠ শুনল
মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম ইবনে শিহাব আল-জুহরি আমাকে বলেছেন, তাঁকে কেউ বলেছে যে, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আবু জেহেল ইবনে হিশাম এবং বনু জুহরার মিত্র আল-আখনাস ইবনে শারিক ইবনে আমর ইবনে ওয়াহাব আল-সাফাফি একদিন রাতে রাসুলে করিমের (সা.) বাড়িতে গিয়েছিল রাসুলে করিমের (সা.) নামাজ পড়া শোনার জন্য। প্রত্যেকে বসার এমন জায়গা বেছে নিল, যাতে সবকিছু স্পষ্ট করে শুনতে পায়। কে কোথায় বসেছে, তা আবার কেউ জানল না। তারা সারা রাত কাটিয়ে দিল শুনে শুনে। তারপর ভোর হয়ে গেল যখন, তারা সবাই উঠে পড়ল। ফেরার পথে সবার সঙ্গে সবার দেখা হয়ে গেল। প্রত্যেকে প্রত্যেককে হুঁশিয়ার করে দিল, ‘অমন কাজ আর কখনো করবে না। কারণ বলা তো যায় না, অল্পবুদ্ধি কেউ দেখে ফেললে তার মনে সন্দেহ জাগবে।’ ওরা সবাই চলে গেল। দ্বিতীয় রাতে সবাই আবার যে যার স্থানে এসে বসল, সারা রাত শুনল। পরদিন ভোরে সেই আগের দিনের ভোরের মতো ঘটনা ঘটল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো তৃতীয় রাতেও। তার পরের রাতে তারা বলাবলি করল, ‘আগামীকাল এখানে আর আসব না আমরা, এই কসম না খেয়ে আমরা আজ যাব না।’ তারা প্রতিজ্ঞা করল, প্রতিজ্ঞা করে যে যার পথে চলে গেল। ভোরে ছড়ি হাতে আল-আখনাস গেল আবু সুফিয়ানের বাড়িতে। মুহাম্মদের (সা.) মুখ থেকে যা সে শুনেছে, তার ওপর তার মতামত জানতে চাইল। আবু সুফিয়ান জবাব দিল, ‘আল্লাহ্র কসম, যা শুনেছি, তার কিছু কিছু জিনিস আমি জানি, তাদের অর্থ বুঝি। আর কিছু শুনেছি, যার না জানি অর্থ, না বুঝি তার উদ্দেশ্য।’
আল-আখনাস বলল, ‘আমারও সেই একই কথা।’
আল-আখনাস অতঃপর গেল আবু জেহেলের বাড়িতে। তাকেও সেই একই কথা জিজ্ঞেস করল।
আবু জেহেল জবাব দিল, ‘কী কথা শুনেছি! আরে আমরা তাঁর বানু-আবদু মোনাফরা তো ইজ্জতের প্রতিদ্বন্দ্বী। তারা গরিবকে খাইয়েছে, আমরাও খাইয়েছি। ওরা পরের বোঝা কাঁধে নিয়েছে, আমরাও নিয়েছি। ওরা দরাজ-দিল, আমরাও তা-ই। আমরা দুই ঘরই পাশাপাশি একই গতিতে উন্নতি করেছি। আমরা একই তেজের দুটি ঘোড়ার মতো। ওরা বলছে, ‘আমাদের এক নবী আছে, আসমান থেকে তার কাছে ওহি আসে। আমাদের ওই জিনিস কখন হবে? আল্লাহ্র কসম, আমরা কোনো দিন তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করব না, কোনো দিন তাকে সত্যবাদী বলে মানব না।’
আল-আখনাস তখন উঠে চলে গেল।
রাসুলে করিম (সা.) কোরআন শরিফ আবৃত্তি করে তাদের শোনালেন, আল্লাহ্র পথে আসার জন্য তাদের আহ্বান করলেন। ওরা তাঁকে উপহাস করল। বলল, ‘আমাদের অন্তর ঘোমটা দেওয়া, তোমার কোনো কথা আমরা বুঝি না। আমাদের কানের ভেতরে আছে বোঝা, তুমি কী বলো আমরা শুনি না। একটা পর্দা আমাদের তোমার কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে। কাজেই তোমার পথ তুমি দেখো, আমাদের পথ আমরা দেখব। তোমার কোনো কথা আমরা বুঝি না।
তখন আল্লাহ্, প্রত্যাদেশ করলেন, ‘এবং যখন তুমি কোরআন পাঠ করো, তখন তোমার ও যারা পরলোকে বিশ্বাস করে না, তাদের মধ্যখানে প্রচ্ছন্ন এক পর্দা রেখে দিই।’ এখান থেকে ‘এবং যখন তুমি কোরআনে বলো যে “তোমার প্রভু এক” তখন তারা সরে পড়ে’ এই পর্যন্ত। এর অর্থ হলো, তাদের কথামতো আমি তাদের অন্তরের ওপর আবরণ দিয়ে থাকি, কোনো ভারী জিনিস দিয়ে কান বন্ধ করে দিয়ে থাকি এবং তোমার আর তাদের মাঝখানে পর্দার আড়াল দিয়ে থাকি, তাহলে তারা তোমার কথা বুঝবে কেমন করে? অর্থাৎ, ওরা যা বলছে, তা আমি করিনি। ‘যখন ওরা কান পেতে তোমার কথা শোনে, তখন তারা কেন কান পেতে শোনে, তা আমি ভালো করে জানি। এবং আরও জেনো, গোপনে আলোচনাকালে সীমা লঙ্ঘনকারীরা বলে, ‘তোমরা এক জাদুগ্রস্ত লোককে অনুসরণ করছ।’ অর্থাৎ, এমনি করে আমার বার্তায় কর্ণপাত না করার জন্য লোকজনকে তারা হুকুম দেয়। ‘দেখো ওরা তোমার কী রকম উপমা দেয়, ‘তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে, তারা পথ খুঁজে পাবে না।’ অর্থাৎ, তারা তোমার সম্পর্কে ভ্রান্ত উপমা তৈরি করেছে, তারা যথার্থ পথ পাবে না, তাদের কথা সরল নয়। ‘এবং তারা বলে, আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হলেও কি নতুন সৃষ্টিরূপে পুনরুত্থিত হব?’ অর্থাৎ, তুমি আমাদের বলতে এসেছ যে মরার পর আমাদের অস্থি যখন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, যখন মজ্জা শুকিয়ে যাবে, তখনো আমাদের পুনরুত্থিত করা হবে—যা নাকি হওয়ার নয়। ‘বলো, তোমরা পাথরই হও আর লোহাই হও অথবা এমন কিছু, যা তোমাদের ধারণায় কঠিন, তারা বলবে ‘কে আমাদের পুনরুত্থিত করবে?’ বলো, ‘তিনি, যিনি তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন।’ অর্থাৎ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছিলেন, তোমরা জানো কী থেকে তা করেছিলেন, তিনিই পুনরুত্থিত করবেন, কারণ যিনি ধুলা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করতে পারেন, তাঁর কাছে এ কাজটা নিশ্চয়ই খুব কঠিন নয়।
ইবনে আব্বাসের সূত্রে মুজাহিদ সেই সূত্রে আবদুল্লাহ্ বিন আবু নাজিহ আমাকে বলেছেন, ইবনে আব্বাস বলেছিলেন, ‘অথবা এমন কিছু যা তোমাদের ধারণায় খুব কঠিন’ বলতে কী বোঝায়, আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘মৃত্যু।’
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে