ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি দাওয়াতের প্রচলিত মাধ্যমগুলোর অন্যতম। ‘ওয়াজ’ হলো সুন্দর আকর্ষণীয় যুক্তিপূর্ণ হৃদয়স্পর্শী আবেদনময় আলোচনা। যিনি ওয়াজ করেন, তাঁকে ওয়ায়েজ বলে। ওয়ায়েজিন হলো এর বহুবচন। মাহফিল হলো সভা, সমাবেশ, সম্মেলন ইত্যাদি। মাহফিলকে আরবিতে ‘হাফলা’ বলা হয়। ধর্মীয় আলোচনা সভাকে ওয়াজ মাহফিল বলা হয়।
কোরআন মাজিদের ৭৭টি নামের একটি নাম হলো ‘ওয়াজ’ বা উপদেশ। আল্লাহ তাআলা হলেন প্রথম ওয়ায়েজ বা ওয়াজকারী। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন দ্বিতীয় ওয়ায়েজ। এই সূত্রে নবী করিম (সা.)–এর উত্তরাধিকারীরা ওয়ায়েজিন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ১২৫)
ওয়াজ ও বয়ান যেমন হওয়া উচিত: সাধারণত কোরআনের আয়াত, নবীজি (সা.)–এর হাদিস, ফিকহি মাসায়েল ও উপদেশমূলক কাহিনি ওয়াজ ও বয়ানের মূল প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত। মুফতি আযম ফয়জুল্লাহ্ (র.) বলেন, যে ওয়াজে কোরআনের বয়ান সবচেয়ে বেশি, তারপর হাদিসের বয়ান এবং গল্প-কাহিনি সবচেয়ে কম; সেই ওয়াজ বেশি উপকারী।
যুক্তিসংগত ও যৌক্তিক কারণ ছাড়া মাহফিলের তারিখ প্রত্যাহার করা মোটেই সমীচীন নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং প্রতিশ্রুতি পালন করো; নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত-৩৪)
ওয়াজে ও বয়ানে যা থাকা উচিত: ওয়াজে সাধারণত তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত; ইমান ও আমল, হাক্কুল্লাহ তথা আল্লাহর হক ও হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক; হারাম ও হালাল; লেনদেন, আচার–ব্যবহার, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি থাকা উচিত।
ওয়াজে ও বয়ানে যা থাকা অনুচিত: বিতর্কিত মাসআলা–মাসায়েল, অপ্রয়োজনীয় অভিনব বিষয়, মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ, ভুল–বোঝাবুঝি ও সংশয় সৃষ্টি হতে পারে, এমন কোনো বিষয় ওয়াজ ও বয়ানে থাকা উচিত নয়।
ওয়ায়েজের জরুরি গুণাবলি: পর্যাপ্ত শিক্ষাগত ইলমি যোগ্যতা, অবয়ব সুরত সুন্নত মোতাবেক হওয়া, আখলাক সিরাত নবী (সা.)–এর আদর্শে আদর্শিত হওয়া, পোশাক ইসলামি সংস্কৃতির অনুকূলে থাকা, তাকওয়ার অধিকারী মুত্তাকি হওয়া, ইখলাসওয়ালা মুখলিস হওয়া, তাওয়াক্কুল আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা থাকা, ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু হওয়া, কপটতামুক্ত সরলমনা হওয়া, বিনয়ী হওয়া, সুমিষ্টভাষী হওয়া, ভদ্র ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন হওয়া, দূরদর্শী হওয়া, সব বিষয়ে মতামত না দেওয়া বা কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য না করা, নিজের বিদ্যা ও পাণ্ডিত্য জাহির না করা, হিকমতের সঙ্গে কথা বলা, প্রয়োজনমতো কোরআনের আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করা, সহিহ্ কাহিনি বলা, উদ্ধৃতি যেন নির্ভুল হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা; শব্দ, বাক্য ও উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়া, তাজবিদসহ বিশুদ্ধ তিলাওয়াত করা, গ্রামারসহ আরবি পাঠ করা, কথায় ও কাজে মিল থাকা, উম্মতের ইসলাহ তথা সংশোধন ও কল্যাণকামিতার মনোভাব থাকা, ইতিবাচক কথা ও আশার বাণী শোনানো এবং নিয়ত সহিহ্ থাকা।
ওয়াজ ও বয়ানের ভাষা: ওয়ায়েজকে ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। শব্দচয়নে, বাক্যবিন্যাসে ও ভাষার ব্যবহারে মার্জিত ও সুরুচি বোধসম্পন্ন হতে হবে। এমন কোনো শব্দ বা বাক্য বলা যাবে না, যা শোভন নয়।
ওয়াজ ও হাদিয়া: হাদিয়া দেওয়া ও নেওয়া সুন্নত। তবে ওয়াজ করে তার বিনিময় গ্রহণ না করাই উত্তম। এতে এর সুফল বা প্রভাব কমে যায়। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অনুসরণ করো তাদের, যারা তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চায় না এবং যারা সৎ পথপ্রাপ্ত’। (সুরা-৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ২১)
সেবার প্রতিদান ও পারিশ্রমিক: ধর্মীয় সেবা প্রদান করে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ হলেও, তা উত্তম নয়। তাই সামর্থ্যবানদের জন্য তা পরিহার করাই শ্রেয়। এটাই ইখলাস ও তাকওয়ার উচ্চস্তর। নবী–রাসুলগণ দাওয়াতি কাজের শেষে সাধারণত এভাবেই বলতেন, ‘আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না, আমার পুরস্কার তো জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে।’ (সুরা-২৬ শোআরা, আয়াত: ১০৯, ১২৭, ১৪৫, ১৬৪ ও ১৮০)
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা জরুরি: যুক্তিসংগত কারণ ও যৌক্তিক কারণ ছাড়া মাহফিলের তারিখ প্রত্যাহার করা মোটেই সমীচীন নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং প্রতিশ্রুতি পালন করো; নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত-৩৪)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম