নারীদের প্রতিষ্ঠা করা মসজিদ ও মাদ্রাসা

আরব ও ইসলামের ইতিহাসে বহু ধনী নারী সন্ধান পাওয়া যায়। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব তাঁর বাবা ও স্বামীর। তাঁদের অনেকে বাবা আর স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পেতেন। দেনমোহর পেতেন। অনেকের স্বামী বার্ষিক হাতখরচের টাকাও দিতেন।

বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ তাঁর উইলে লিখে যান, তাঁর কাছে তাঁর স্ত্রী অনাদায়ী হাতখরচ বাবদ ৩০০ দিনার পাবেন। এই অর্থে তখন মিসরে একটি বাড়ি কেনা যেত।

সম্পত্তি, মোহরানা বা হাতখরচের জন্য পাওয়া এত টাকা দিয়ে তাঁরা কী করতেন? মধ্যযুগে স্বচ্ছল কোনো কোনো নারীর কাছে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার সম্পদ থাকত। ধনী পরিবারের নারীদের হাতে থাকত কোটি টাকার সম্পদ।

আরও পড়ুন

এ রকম এক নারী ছিলেন ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল-ফিহরি রাহিমাহাল্লাহ। তাঁর বাবা মুহাম্মদ আল-ফিহরি ছিলেন ফাস শহরের (বর্তমান তিউনিসিয়ার) বড় ব্যবসায়ী। বাবার ইন্তেকালের পর তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন ফাতিমা আর তাঁর বোন মারিয়াম।

দুই বোনের হাতে বাবার কোটি কোটি টাকার সম্পদ। ফাতিমা আল-ফিহরি নিজে ছিলেন মুহাদ্দিসা। পারদর্শী ছিলেন ফিক্বহেও। আলেমা হিসেবে তিনি অনুভব করেন তাঁর শহরে একটি বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ থেকে তিনি জমি কেনেন। সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে যেন হারাম কিছু প্রবেশ না করে।

সেই জমিতে মাদ্রাসা গড়ে তুলতে কয়েক বছর লেগে যায়। এই সময়টাতে ফাতিমা প্রায় প্রতিদিন রোজা রাখতেন। ২৪৫ হিজরির রামাদান মাসের ১ তারিখ মাদ্রাসাটির উদ্বোধন হয়। মুসলিম নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব ফাতিমা আল-ফিহরির।

ফাতিমার আরেক বোন মারিয়াম। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ থেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মসজিদ। মসজিদটি জামেউল আন্দালুস নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন

মক্কার প্রধান বিচারপতি ছিলেন শায়েখ শিহাবুদ্দিন তাবারি রাহিমাহুল্লাহ। তাঁর মেয়ে উম্মে হুসাইন রাহিমাহাল্লাহ ছিলেন একজন মুহাদ্দিসা ও ফক্বিহা।

উম্মে হুসাইন মক্কায় একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে সেখানে এতিম ছেলেমেয়েরা থাকতে পারবে, খেতে পারবে, পড়াশোনা করতে পারবে। কাজটি যাতে নির্বিঘ্নে চলে, সে জন্য উম্মে হুসাইন মক্কা ও মক্কার বাইরে বহু সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ করে যান।

মিসরের সুলতান নাসের মুহাম্মদ ইবনু মালিকের মেয়ে ৭৬১ হিজরিতে মিসরে মাদ্রাসাতুল হেজাজিয়্যাহ নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসায় একটি বড় গ্রন্থাগার ছিল। সেখানে গিয়ে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে জ্ঞানের সাধনা করতে পারেন, সে জন্য অসংখ্য বই ওয়াক্‌ফ করে রাখা হয়।

খলিফা নাসির লিদিনিল্লাহ আহমদের মায়ের নাম ছিল জামরাদ। তুর্কি বংশোদ্ভূত এই নারী একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

তুরকান বিনতে মালিক ছিলেন বাদশাহ আশরাফ মুসার স্ত্রী। তিনি সিরিয়ায় মাকামে জাবালে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসাটি তাঁর নামেই প্রসিদ্ধ ছিল। এই মাদ্রাসা প্রাঙ্গণেই তাঁকে দাফন করা হয়।

সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি রাহিমাহুল্লার বোন ছিলেন রাবিয়া খাতুন রাহিমাহাল্লাহ। তিনিও সিরিয়ায় মাকামে জাবালে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁকেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা–প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়।

তাবুজ্জামান হাবশিয়্যাহ নামে খলিফা মুস্তাজি বিআমরিল্লাহ হাসানের একজন দাসী ছিলেন। তাবুজ্জামান হাবাশিয়্যাহ ৫৮০ হিজরিতে মক্কায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

আরও পড়ুন

উসমানি সুলতান মুরাদ শাহের মা ইস্কাদার শহরে বিশাল একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আলেমদের জড়ো আমন্ত্রণ জানানো হয়। সুলতানের মা সবাইকে এক হাজার দিনার করে হাদিয়া দেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসা ৫০ জন আলেমকে সেই মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

খাতুন উম্মে সালেহ নামে দামেস্কের এক নারী একটি বিশেষ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে শুধুমাত্র ইলমে তাজবিদ ও ইলমে কেরাতের ওপর ক্লাস নেওয়া হতো।

মুসলিম ইতিহাসে এভাবে বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে নারীরা অবদান রাখেন। হজরত আবদুল কাদের জিলানি রাহিমাহুল্লাহ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে একজন নারী তাঁকে তাঁর মোহরানার টাকা দিয়ে দেন।

বাংলাদেশেও কিছু মসজিদ ও মাদ্রাসা নারীরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ঢাকায় ৮৬১ হিজরিতে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের মেয়ে মুসাম্মাত বখত বিনত বিবি নারিন্দা অঞ্চলে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।

 আরিফুল ইসলাম: লেখক

আরও পড়ুন