ইসলাম গ্রহণ ছিল তাঁর বিয়ের মোহরানা
আবু তালহা আল আনসারি ছিলেন অবিশ্বাসী। তিনি উম্মু সুলাইম বিনতে মিলহান (রা.)–কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব পেয়ে উম্মু সুলাইম বললেন, এ প্রস্তাবে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তুমি অবিশ্বাসী আর আমি মুসলমান নারী। এ বিয়ে তো হতে পারে না।
আবু তালহা বললেন, তুমি কি সোনা-রুপা চাও? আমি বহু মূল্যবান জিনিস তোমাকে দিতে রাজি আছি।
উন্মু সুলাইম বললেন, না, আমি সেসব চাই না। তুমি যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো, তার বিনিময়েই আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি আছি। তোমার ইসলাম গ্রহণই হবে আমার বিয়ের মোহরানা।
কয়েক দিন ভাবনা–চিন্তার পর আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করে উম্মু সুলাইমকে তাঁর শর্তে বিয়ে করলেন।
উম্মু সুলাইম (রা.) প্রখ্যাত সাহাবি আনাস ইবনে মালিকের মা। আনাসের বাবা ছিলেন উম্মু সুলাইমের আগের স্বামী মালিক। উম্মু সুলাইম আর আনাস ইসলাম গ্রহণ করলে মালিক তাদের ত্যাগ করেন।
পরে তাঁর মৃত্যু হলে উম্মু সুলাইম (রা.) বিধবা হন। শিশুপুত্র আনাসকে (রা.) নিয়ে তখন তিনি খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি ঠিক করলেন, ছেলে বড় হয়ে যখন তাঁকে বিয়ে করতে মত দেবে, তখন তিনি বিয়ে করবেন। আনাস (রা.)–র উপযুক্ত বয়স হলে আবু তালহা আর উম্মু সুলাইমের সেই বিয়ের ঘটনাটি ঘটে।
উম্মু সুলাইম (রা.)–র জন্ম মদিনায়। তিনি নিজে উৎসাহী হয়ে রাসুল (সা.)–এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাসুল (সা.) আনসারি নারীদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তাঁরা সৈনিক এবং আহত সাহাবিদের সেবা করতেন।
আনাস (রা.) বলেছেন, ‘আমি আয়েশা (রা.) আর আমার মা উম্মু সুলাইমকে মশক ভরে পানি এনে আহতদের পান করাতে দেখেছি। মশক খালি হয়ে গেলে তাঁরা আবার ভরে এনে পান করিয়েছেন।’ (বুখারি, হাদিস: ২/৫৮১)
উম্মু সুলাইম (রা.) হুনাইনের যুদ্ধে অংশ নেন।
রাসুল (সা.)–এর মদিনায় হিজরতের পর উম্মু সুলাইম তাঁর শিশুপুত্র আনাসকে রাসুল (সা.)–এর কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আনাসকে আপনার কাছে রেখে গেলাম। সে আপনার সেবা করবে। আনাসের বয়স তখন ১০ বছর। সেদিন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি রাসুল (সা.)–এর সেবা করে গেছেন।
আবু তালহার পক্ষে উম্মু সুলাইমের দুটি ছেলে হয়—আবু উমাইর আর আবদুল্লাহ। আবু উমাইর শৈশবেই মারা যায়। অসুস্থ ছেলেকে ঘরে রেখে আবু তালহা (রা.) কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছেলের মৃত্যু হয়েছে। দিনের শেষে ফিরে এসে আবু তালহা ছেলের অবস্থা জানতে চাইলে উম্মু সুলাইম (রা.) বলেন, তুমি যে অবস্থায় রেখে গেছ, তার চেয়ে ভালো আছে।
আবু তালহা নিশ্চিন্ত হয়ে শুতে গেলেন।
উম্মু সুলাইম (রা.) আবু তালহাকে বলেন, যদি কেউ তোমার কাছে কিছু গচ্ছিত রেখে পরে তা ফেরত নিতে আসে, তুমি কি সেটা ফেরত দিতে অস্বীকার করবে?
আবু তালহা (রা.) বললেন, কখনোই না।
উম্মু সুলাইম (রা.) তখন বললেন, তাহলে শোনো, তোমার সন্তানটিও ছিল আল্লাহর আমানত। তিনি তা ফেরত নিয়ে গেছেন।
খবর শুনে আবু তালহা (রা.) ‘ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন’ পড়লেন।
ভোরে এ ঘটনা রাসুল (সা.)–কে জানানো হয়। তিনি তাঁদের ধৈর্যের কাহিনি শুনে খুব তৃপ্ত হয়ে দোয়া করেন যাতে আল্লাহ তাঁদের উত্তম প্রতিদান দেন।
কিছুদিন পর উম্মু সুলাইম (রা.)–র একটি ছেলেসন্তান হয়। রাসুল (সা.) খবর পেয়ে আনাসকে বলেন, তোমার মাকে গিয়ে বলো শিশুটির নাড়ি কাটার পর আমার কাছে না পাঠিয়ে তার মুখে যেন কিছু না দেয়।
আনাস (রা.) বলেন, মা আমার হাতে শিশুটিকে তুলে দিলে আমি রাসুল (সা.)–এর কাছে তাকে নিয়ে আসি। রাসুল (সা.) বিচি ফেলে কিছু আজওয়া খেজুর মুখে নিয়ে ভালো করে চিবান। তারপর শিশুটির মুখ ফাঁক করে খেজুরগুলো ঢুকিয়ে দেন। শিশুটি মুখ নেড়ে তা চুষতে থাকে।
এ দৃশ্য দেখে রাসুল (সা.) খুশি হয়ে বলেন, আমার আনসাররা খেজুর পছন্দ করে।
রাসুল (সা.) শিশুটির নাম রাখেন আবদুল্লাহ। তার জন্য দোয়া করেন।
রাসুল (সা.)–এর সঙ্গে যখন সাফিয়া (রা.)–র বিয়ে হয়, তখন উম্মু সুলাইম (রা.) তাঁকে সাজিয়ে রাসুল (সা.)–এর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। (মুসলিম, হাদিস: ১/৫৪৬)
পঞ্চম হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর সঙ্গে যয়নাব (রা.)–র বিয়ে হলে উম্মু সুলাইম (রা.) নিজ হাতে খুব সুন্দর কারুকাজ করে তাঁকে একটি পশমি পোশাক উপহার দিয়েছিলেন। (মুসলিম, হাদিস: ১/৫৫০)
উত্তমভাবে ইসলাম জানার জন্য তিনি রাসুল (সা.)–কে নির্ভয়ে প্রশ্ন করতেন। হাদিস শাস্ত্রে তাঁর ভালো জ্ঞান ছিল। মানুষ তাঁর কাছে মাসয়ালা জিজ্ঞেস করত। একটি মাসয়ালা নিয়ে হজরত যায়িদ ইবনে সাবিত (রা.) এবং হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.) মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে তিনি তার সমাধান করে দেন।
তাঁর প্রজ্ঞা ছিল অতি প্রখর। ঐতিহাসিক ইবনুল আসির লেখেন, উম্মু সুলাইম (রা.) ছিলেন বুদ্ধিমতী নারীদের অন্যতম