হজের প্রস্তুতি হিসেবে অনেক কিছু জানা বোঝার প্রয়োজন হয়। কারণ, এটা অনেক বড় পরিসরের ইবাদত। আবার বেশির ভাগ মুসলমানই জীবনে একবারই হজ করার সুযোগ পান। পরে এক বা একাধিকবার আল্লাহ সুযোগ করে দিলেও প্রথমবারেরটাই ফরজ হজ। কাজেই ফরজ হজটা যথাসম্ভব নির্ভুল করা চেষ্টা থাকা জরুরি।
হজের প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য আমাদের এলাকার মসজিদে পাঁচ দিনের একটি কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছিল রমজান শেষ হওয়ার পরের সপ্তাহেই। আমাদের বাসভবনের অন্যতম বাসিন্দা মাহমুদ ভাই ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তা। তিনি নিজেও একাধিকবার হজ করেছেন। আর এই কর্মশালা পরিচালনা করেছিলেন হজরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহ্ইয়া সিদ্দিক। প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের পর থেকে ইশার নামাজ পর্যন্ত এটি হয়। এখানে ইয়াহ্ইয়া হুজুর সুন্দরভাবে হজের ইতিহাস ও আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত যা যা করণীয় তা সহজ ভাষায় তুলে ধরেন। তিনি যা বলেছিলেন তার কিছু চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করছি।
প্রথমত, এ দুনিয়ায় আল্লাহকে দেখা যাবে না, তবে তাঁর ঘর বা বায়তুল্লাহ দেখা যাবে। আর সেটা দেখতেই হজে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, হজরত আদম (আ.) থেকে সকল নবী-রাসুলকে দিয়ে আল্লাহ কাবাঘর তাওয়াফ করিয়েছেন। সৃষ্টিলগ্ন থেকে প্রতিদিন ফেরেশতারা কাবাঘর তাওয়াফ করে আসছে। তাই ‘ফেরেশতাদের নুরানি মিছিলে আল্লাহ যে আমার মতো পাপী-গোনাহগারকে শামিল হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন’, এই অনুভূতি অন্তরে জাগ্রত রেখে তাওয়াফ করতে হবে। তৃতীয়ত, লাখ লাখ হাজি দেখে ‘ভিড়’ না বলে ‘আল্লাহর মেহমানদের সমাগম অনেক বেশি, মাশাআল্লাহ’ বলতে হবে ও সেভাবেই ভাবতে হবে।
ইয়াহ্ইয়া হুজুর আমাদের আরও বলেছিলেন যে আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানি ছাড়া হজ হয় না, হজ করা যায় না। হজে গিয়ে সবর না শিখলে কেউ জীবনে তা শিখতে পারবে না। আর হজে গিয়ে কলহ-ঝগড়া করলে আল্লাহ লজ্জিত হন। আল্লাহ হজে গিয়ে ঝগড়া না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া হজে গিয়ে অস্থির-বিচলিত হওয়া যাবে না।আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে।
কর্মশালায় আমরা তাঁর কাছ থেকে জানতে ও বুঝতে পারি যে পবিত্র হজের তিনটি মৌলিক ফরজ বা বাধ্যতামূলক কাজ। এগুলো হলো: ১. ইহরাম বাঁধা; ২. ওয়াকুফে আরাফা বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান; এবং ৩. তাওয়াফে জিয়ারত বা কাবাঘরে ফরজ তাওয়াফ। এই তিনটার যে কোনো একটা ছুটে গেলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে হজ বাতিল হয়ে যাবে, কোনো ক্ষতিপূরণের সুযোগ নেই। পরের বার আবার নতুন করে করতে হবে।
হজের ছয়টি মৌলিক ওয়াজিবও ব্যাখ্যা করেন ইয়াহ্ইয়া হুজুর। এগুলোর মধ্যে দুটো হলো মক্কায়: ১. সাফা-মারওয়ায় সায়ী; এবং ২. বিদায়ী তাওয়াফ। তিনটি হলো মিনায়: ১. জামারাতে রমি বা পাথর নিক্ষেপ; ২. দমে শোকর বা হজের কোরবানি; এবং ৩. মাথা কামানো। আরেকটি ওয়াজিব হলো মুজদালিফায় সুবহ সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করা। এগুলোর যে কোনো ছুটে গেলে হজ দুর্বল হয়ে যায়, তাই ক্ষতিপূরণ বা দম দিতে হয়।
ইয়াহ্ইয়া হুজুর স্পষ্ট ভাষায় আমাদের এটাও জানিয়ে-বুঝিয়ে দেন যে তালবিয়া হলো ফরজ ও একমাত্র দোয়া যা মুখস্থ করতে হবে। তালবিয়া হলো: ‘লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নিয়ামাতা, লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারিকা লাক।’ এই তালবিয়া পাঠ হলো আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দাওয়াতে সাড়া দেওয়া। এটা বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় সংগীত। আর কোনো দোয়া মুখস্থ করা জরুরি নয়। নিজের ভাষায় প্রাণখুলে দোয়া করতে হবে ও আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এও বলেন যে মক্কায় অবস্থানকালে অনেকে নফল ওমরাহ করার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন যা ঠিক নয়। বরং বেশি করে তাওয়াফ করার চেষ্টা করা উচিত। শিফার নিয়তে বারবার জমজমের পানি পান করার কথাও বলেন তিনি। মাকামে ইব্রাহিম, হজরে আসওয়াদ এবং জমজম কূপ পবিত্র কাবাঘরের চারপাশে আল্লাহর অসীম কুদরতের তিনটি নিদর্শন বলেও উল্লেখ করেন।
এই কর্মশালা থেকে আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি। বিভিন্ন মসলা-মাসায়েল জেনেছি, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। এখান থেকেই ইয়াহ্ইয়া হুজুরের লেখা ছোট্ট একটা হজ নির্দেশিকা সংগ্রহ করেছি। এছাড়া আবু তাহের মিছবাহ্ রচিত হজ সফরের দুটো বই ‘বাইতুল্লাহর ছায়ায়’ ও ‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’ নামে দুটো বই সংগ্রহ করি। একটির মধ্যে হাফেজ্জী হুজুরের একবারের হজ সফরের বিবরণ আছে।
আবার মে মাসে এক বিকেলে হজ ক্যাম্পে সরকারি হাজিদের জন্য আধাবেলার একটি কর্মশালায় যোগ দেই। ওটাও খুব উপকারী হয়েছিল বিশেষত হজের সময়ে থাকা-খাওয়া ও চলাচলের বিষয়ে বাস্তব পরামর্শ ও নির্দেশনা পেয়ে। একটু বুঝে-শুনে খাবার খাওয়া, ওষুধপত্র একটু বেশি নেওয়া, জিয়ারার জন্য এদিক-ওদিক বেশি ছোটাছুটি না করা, পাহাড় বেয়ে ওপরে না ওঠার পরামর্শ দেয়া হয়। ওখানে এটাও বলা হয় যে বাংলাদেশি হাজিরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেটাও মনে রাখতে হবে। বলতে দ্বিধা নেই যে সদিচ্ছা থাকলে সরকারিভাবে হজের ব্যবস্থাপনা চমৎকার হতে পারে তার একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সেদিনই আমাদের হয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ।
আবার হজ ব্যবস্থাপনা পোর্টালে (hajj.gov.bd) নিয়মিতভাবে সকল তথ্য হালনাগাদ করা হতে থাকায় ওখান থেকে অনেক খবরই জানা সম্ভব হচ্ছিল। এটাকে আরও সহজে ব্যবহারোপযোগী করার জন্য ই-হজ প্রবর্তন করা হয় এবং মোবাইল ফোনের জন্য ই-হজ অ্যাপ চালু করা হয়।