মদিনায় রাসুল (সা.)-কে যিনি আশ্রয় দিলেন
আল্লাহর নির্দেশে নবুয়তের ১৩তম বছরে রাসুল (সা.) এবং মক্কার মুসলমানরা মদিনায় হিজরত করেন।
মদিনার মানুষ রাসুল (সা.)-এর আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন। আনসারদের একটি দল নিয়মিত প্রতিদিন সকালে মদিনার চার-পাঁচ মাইল দূরে ‘হাররা’ নামক স্থানে চলে যেতেন। হজরত আবু আইয়ুব আল-আনসারী (রা.) এ দলের একজন সদস্য ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সম্ভাব্য আগমন পথের দিকে তাকিয়ে দলটি দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করত। একদিন তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন, এমন সময় এক ইহুদি বহুদূর থেকে রাসুল (সা.)-কে দেখতে পেয়ে তাঁদের খবর দেয়। আনসাররা মহানবী (সা.)-কে স্বাগত জানাতে দ্রুত ছুটে যান।
মদিনার উপকণ্ঠে কুবা নামে একটি জায়গায় কয়েক দিন থাকার পর রাসুল (সা.) মদিনার মূল শহরের দিকে রওনা হলেন। রাস্তার দুই পাশে মদিনাবাসী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মদিনার শিশু-কিশোরেরা নাত গেয়ে রাসুল (সা.)-কে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।
আনসার সাহাবিরা প্রত্যেকেই চাইছিলেন রাসুল (সা.)-কে আতিথেয়তা দিতে। সবাই তাঁকে তাঁদের বাড়িতে মেহমান হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর বাহন মাদি উটের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের বারবার বলছিলেন, ‘তোমরা ওর পথ ছেড়ে দাও। ও আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত।’
মাদি উটটি যেতে যেতে একসময় আবু আইয়ুব আল-আনসারী (রা.)-এর বাসার কাছে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। রাসুল (সা.) নেমে পড়লেন। আবু আইয়ুব (রা.)-এর মন আনন্দে ভরে গেল। তিনি মহানবী (সা.)-এর মেহমানদারি করার গৌরব অর্জন করলেন।
রাসুল (সা.) মসজিদ এবং মসজিদের কাছে তাঁর নিজের বাড়ি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আবু আইয়ুব (রা.)-এর বাসায় থেকেছিলেন। আবু আইয়ুব (রা.) অত্যন্ত ভালোবাসা ও বিনয়ের সঙ্গে মেহমানদারির দায়িত্ব পালন করেন।
আবু আইয়ুব (রা.)-এর বাসা ছিল দোতলা। রাসুল (সা.)-এর জন্য তিনি ওপরের তলাটি ঠিক করেছিলেন। কিন্তু রাসুল (সা.) তাঁর নিজের এবং সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সুবিধার কথা ভেবে নিচতলা পছন্দ করেন। এখানে থাকা অবস্থায় কখনো আবু আইয়ুব (রা.), কখনো অন্য আনসাররা পালাক্রমে রাসুল (সা.)-কে খাবার পাঠাতেন।
রাসুল (সা.) ছয়-সাত মাস এ বাসায় থাকেন। মসজিদে নববি এবং এর পাশে ঘর তৈরি হলে তিনি সেখানে চলে যান।
একদিন দুপুরের প্রচণ্ড গরমে আবু বকর (রা.) মসজিদে নববিতে এলেন। উমর (রা.) তাঁকে দেখে বললেন, ‘এই প্রচণ্ড গরমে আপনি বাইরে এলেন কেন?’
আবু বকর (রা.) বললেন, ‘খুব ক্ষুধা পেয়েছে, তাই বাইরে বের হয়ে এসেছি।’
উমর (রা.) বললেন, ‘আমিও একই কারণে বাইরে বের হয়েছি।’
রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমিও ঠিক একই কারণে বাইরে বের হয়ে এসেছি।’
রাসুল (সা.) তাঁদের দুজনকে নিয়ে আবু আইয়ুব (রা.)-এর বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। আবু আইয়ুব (রা.) প্রতিদিন রাসুল (সা.)-এর জন্য কিছু খাবার রেখে দিতেন। রাসুল (সা.) নির্দিষ্ট সময়ে না এলে তাঁর পরিবারের লোকেরা তা ভাগ করে খেয়ে ফেলতেন। রাসুল (সা.) আর তাঁর সঙ্গীরা দরজায় পৌঁছালে তাঁদের স্বাগত জানালেন আবু আইয়ুব (রা.)-এর স্ত্রী উম্মে আইয়ুব। রাসুল (সা.) জানতে চাইলেন, ‘আবু আইয়ুব কোথায়?’
আবু আইয়ুব (রা.) বাড়ির কাছেই তাঁর খেজুরবাগানে কাজ করছিলেন। রাসুল (সা.)-এর কণ্ঠ শুনে তিনি ছুটে এসে বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনি তো সাধারণত এ সময় আসেন না!’
রাসুল (সা.) বললেন, ‘ঠিকই বলেছ!’
আবু আইয়ুব (রা.) দৌড়ে বাগানে গিয়ে এক কাঁদি খেজুর কেটে নিয়ে এলেন। তাতে শুকনা, কাঁচা ও পাকা খেজুর ছিল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘পুরো কাঁদি কেটে আনলে কেন?’
আবু আইয়ুব (রা.) বললেন, ‘আপনি এখান থেকে শুকনা, কাঁচা ও পাকা খেজুর খাবেন। তাই কেটে আনলাম। এক্ষুনি একটা বকরিও জবাই করে আনছি।’
রাসুল (সা.) বললেন, ‘যদি করো, তাহলে দুধেল বকরি জবাই কোরো না।’
আবু আইয়ুব (রা.) একটি বকরির বাচ্চা জবাই করলেন। তাঁর স্ত্রী গোশত রান্না করলেন, রুটি বানালেন। রান্নার পরে রাসুল (সা.) আর তাঁর সঙ্গীদের খাবার পরিবেশন করা হলো। তাঁরা তৃপ্তি করে খেলেন। রাসুল (সা.) এক টুকরো গোশত আর একটা রুটি আবু আইয়ুব (রা.)-এর হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা ফাতিমার কাছে নিয়ে যাও। বহু দিন সে এমন খাবার খায়নি।’
আবু আইয়ুব আল-আনসারী (রা.)-এর জন্ম মদিনার বনু নাজ্জার বংশে। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর। মদিনায় ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ার পর মদিনাবাসীর অনেকে ইসলামের ছায়াতলে আসতে শুরু করেন। আকাবার তৃতীয় শপথে আবু আইয়ুব আল-আনসারী (রা.) উপস্থিত ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর হাতে বাইয়াত নিয়ে তিনি মদিনায় ফিরে যান।
আবু আইয়ুব (রা.) ছিলেন কোরআনের হাফেজ। রাসুল (সা.)-এর যুগে আনসারদের মধ্যে পাঁচজন সাহাবি কোরআন সংগ্রহ করতেন। তার মধ্যে আবু আইয়ুব (রা.) একজন। হজরত আবু আইয়ুব (রা.)-এর জ্ঞান আহরণ এবং তা প্রচারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল।
শাওয়াল মাসে যে ছয়টি নফল রোজা রাখতে হয়, এ হাদিস আবু আইয়ুব (রা.)-এর কাছে থেকে পাওয়া যায়। আবু আইয়ুব (রা.)-এর তরফ থেকে ১৫০টি হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে বলে সিরাতের বইগুলোতে উল্লেখ পাওয়া যায়।
আবু আইয়ুব আল-আনসারী (রা.)-এর চরিত্রে তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল: ১. রাসুল (সা.)-এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা। ২. ইমানের দৃঢ়তা। ৩. সত্য ভাষণ। কারও ভয় তাঁকে সত্য বলা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
বদর, ওহুদ, খন্দক, বাইয়াতুর রিদওয়ানসহ বিভিন্ন যুদ্ধ ও অভিযানে আবু আইয়ুব (রা.) রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খলিফাদের যুগের যুদ্ধগুলোতেও তিনি পিছিয়ে থাকেননি। সাহাবা সমাজে তাঁর মর্যাদা ছিল উঁচুতে। অন্য সাহাবিরা তাঁর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে মাসয়ালা জিজ্ঞেস করতেন। কোনো মাসয়ালা নিয়ে সাহাবাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে সবাই তাঁর কাছে ছুটে যেতেন।
হজরত আলী (রা.)-এর খিলাফতের সময় ইবনে আব্বাস (রা.) যখন বসরার গভর্নর, তখন আবু আইয়ুব (রা.) সেখানে গিয়েছিলেন। ‘যেভাবে আপনি রাসুলুল্লাহর জন্য ঘর খালি করে দিয়েছিলেন, আমারও এখন আপনার জন্য সেভাবে ঘর খালি করে দেওয়ার ইচ্ছা।’ এ কথা বলে ইবনে আব্বাস নিজের পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে বাড়িটি তাঁর থাকার জন্য ছেড়ে দেন।
৫২ হিজরিতে মুয়াবিয়া (রা.) যখন রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, আবু আইয়ুব (রা.) ৮০ বছরের বৃদ্ধ। অভিযানের সময় এক মহামারিতে বহু মুজাহিদ মারা যান। আবু আইয়ুব (রা.) ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। মুসলমান বাহিনীর সেনাপতি ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া অন্তিম রোগশয্যায় আবু আইয়ুব (রা.)-এর শেষ ইচ্ছার কথা জানতে চাইলেন।
আবু আইয়ুব (রা.) বললেন, ‘আমি মারা গেলে তোমরা আমার মৃতদেহ ঘোড়ায় চাপিয়ে শত্রুভূমি থেকে যত দূর সম্ভব বাইরে নিয়ে গিয়ে একেবারে শেষ প্রান্তে দাফন করবে।’
আবু আইয়ুব (রা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছাটি বাস্তবায়ন করা হয়।