আনাস ইবনে মালিক (রা.) তাঁর সৎপিতার কাহিনি বর্ণনা করেছেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) ছিলেন উম্মে সুলাইমের পুত্র। তাঁর বাবা ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করে অমুসলিম অবস্থায় মারা যান। তাঁর মা আবু তালহা (রা.) নামে একজন বিখ্যাত সাহাবিকে আবার বিয়ে করেন। সম্পর্কের দিক থেকে আবু তালহা (রা.) আনাস ইবনে মালিকের (রা.) সৎপিতা।
আনাস ইবনে মালিক (রা.) তাঁর সৎবাবা সম্পর্কে বলেন, তিনি ছিলেন আনসারদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং সবচেয়ে বেশি খেজুরগাছের মালিক। মদিনাজুড়ে তাঁর অনেকগুলো বাগান ছিল। মদিনায় গেলে বিভিন্ন ধরনের খেজুরের সেই বাগান দেখতে পাওয়া যায়। মসজিদ আল কুবার কাছাকাছি কিছু উত্থিত জমির মালিক তিনি ছিলেন। বিশেষ করে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বাগানটির নাম ছিল বাইরুহা।
বস্তুত বাগানটি ছিল রাসুল (সা.–এর) খুব প্রিয়। কিন্তু কেন? রাসুল (সা.)–এর মসজিদ, মসজিদুল নববিতে, যেখানে ইমাম নামাজ পড়ান, ঠিক তার সামনেই ছিল বাইরুহা বাগানটি। এই বাগানে শত শত খেজুরগাছ ছিল। এ ছাড়া বাগানটির মধ্যে দিয়ে ঝরনা প্রবাহিত হতো, একটি মরূদ্যানও ছিল। বাগানটিতে পানি ছিল, গাছ ছিল, ছায়া ছিল। সেখানে ভালো মানের খেজুর ফলত।
অনেক সময় রাসুল (সা.) বাইরুহা বাগানের গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতেন, কিছু সাহাবা এখানে এসে অজু করতেন, পানি পান করতেন। যদিও বাগানটি ছিল আবু তালহার (রা.) মালিকাধীন, সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায় এই বাগান থেকে উপকৃত হয়েছিল
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সুরা আল ইমরানে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু খরচ না করা পর্যন্ত কখনো পুণ্যলাভ করবে না, যা কিছু তোমরা খরচ করো—নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে খুব ভালোভাবেই অবগত।’ (৩: ৯২) এখানে (জান্নাত) পুণ্যবানদের পুরস্কার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
আবু তালহা (রা.) এই আয়াতটি শুনে মনে মনে এ কথা ভাবলেন না যে আমার তো অনেকগুলো খেজুরবাগানই আছে, এর মধ্য থেকে যেকোনো একটা আমি রাসুল (সা.)–কে দিতে পারি—মদিনার উপকণ্ঠের বাগানগুলো বা আর যেকোনো একটা। বরং তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আল্লাহ বলেছেন—তোমরা পুণ্যবানদের প্রতিদান অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের ভালোবাসার বস্তু থেকে দান করবে। তাই আমি ভাবলাম আসলে আমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কী? আমার সম্পদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো আমার বাগান বাইরুহা।’
আবু তালহা (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সন্তুষ্টির জন্য আমি আমার এই প্রিয় বাগান বাইরুহা দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর আমার এই সম্পদ বিনিয়োগের মাধ্যমে আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে জান্নাতের প্রত্যাশা করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.), বাগানটি আমি আপনাকে দিলাম, আপনি যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন, কল্যাণকর মনে করেন, আল্লাহ আপনাকে যেভাবে নির্দেশ দেন, সেভাবেই বাগানটি ব্যবহার করুন।’
রাসুল (সা.) বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কী সুন্দর বিনিয়োগ, কী সফল বিনিয়োগ!’ এরপর তিনি বললেন, ‘আপনি যা বললেন, তা আমি শুনেছি।’ আবু তালহার (রা.) প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয়, এই বাগান আপনার পরিবারের জন্য ব্যয় করাই শ্রেয়। আপনি এটি আপনার পরিবারের সদস্যদের দিয়ে দিন।’
রাসুল (সা.) কিছু সাহাবিকে তাঁদের সবকিছু দান করার অনুমতি দিতেন, কিন্তু তিনি চাইতেন না তাঁর সাহাবিরা দারিদ্র্যের মধ্যে নিজেদের সমর্পণ করুক বা পরে নিজেদের সিদ্ধান্তের জন্য অনুশোচনা করুক। আবু তালহাকে (রা.) তিনি বললেন, ‘পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আপনি বাগানটি দান করতে পারেন।’
রাসুল (সা.)–এর এটি প্রজ্ঞা ও মহানুভবতা যে বাগানটি তিনি অপরিচিতদের মধ্যে দান না করে আবু তালহার (রা.) পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দান করতে বললেন। তিনি তাঁকে এও আশ্বস্ত করলেন যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দান করলেও তিনি এর পুণ্য অর্জন করবেন।
আবু তালহা (রা.) বলেন, ‘আমি তা–ই করব হে আল্লাহর রাসুল (সা.)।’ বাগানটি তিনি তাঁর পরিবারের সদস্য এবং তাঁর চাচাতো ভাইদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।
আমরা দেখতে পাই, রমজান মাসে অনেক তহবিল গঠনের আয়োজন করা হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করার আহ্বান জানানো হয়। এ রকম আয়োজন ছাড়াও সুযোগ পেলেই দান করা ভালো। দান করুন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ থেকে, কারণ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আপনার সদকাই আপনার বিশ্বাসের প্রমাণ।’
অনুবাদ: ফাহমিনা হাসানাত