জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে আছে আরাফ
সুরা আরাফ পবিত্র কোরআনের সপ্তম সুরা। এই সুরা আরাফ মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এর আয়াতের সংখ্যা ২০৬।
জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম আরাফ। জান্নাতে আর জাহান্নামে প্রবেশ করার আগে আরাফে জান্নাত ও জাহান্নামিদের মধ্যে কথোপকথন হবে। সুরাটিতে সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের দুর্দশা, শয়তানের কুপরামর্শের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি ও সত্যাশ্রয়ীদের সমৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনায় নুহ (আ.), হুদ (আ.), সালেহ (আ.), লুত (আ.) ও শোয়েব (আ.)-এর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এই সুরায় মুসা (আ.)-এর জীবনীও আছে।
সুরা আরাফের ২০০ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তবে তুমি আল্লাহর শরণ নেবে; নিশ্চয় তিনি সব শোনেন, সব জানেন। আর সেদিন (কিয়ামতের দিন) ন্যায় ও সঠিকভাবে (প্রত্যেকের আমল) ওজন করা হবে, সুতরাং যাদের (পুণ্যের) পাল্লা ভারী হবে তারাই হবে কৃতকার্য ও সফলকাম।’
সুরার ১ থেকে ৭ আয়াতে আল্লাহ আমাদের কোরআন–সুন্নতের আলোকে জীবন গড়ার এবং পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতির পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে বলেন। সুরার ১১ আয়াতে বলা হয় ইবলিশ শয়তান আগুনের তৈরি হওয়ায় মাটির তৈরি হজরত আদম (আ.)–কে সিজদা দিতে অস্বীকার করে। সুরার ১১ থেকে ২৫ আয়াতে একটা গল্প আছে । কীভাবে হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.) শয়তানের ধোঁকার শিকার হয়েছেন এবং তাদের জান্নাত থেকে কেন বের করে দেওয়া হয়, তার বর্ণনা রয়েছে।
২৬ থেকে ৩০ আয়াতে আল্লাহ বনী আদম বলে আদম সন্তানকে (আমাদের) শিক্ষা দিচ্ছেন। শয়তানের প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকতে হবে, পুনরুত্থান হবে। ভালো–মন্দের ফল ভোগ করতে হবে। ৫৫ থেকে ৫৬ আয়াতে আল্লাহকে কীভাবে ডাকব তার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
৫৯ আয়াত থেকে শেষ আয়াত পর্যন্ত নবীদের গল্প রয়েছে। নুহ (আ.) আদম (আ.)-এর পরে নবী হিসেবে নুহ (আ.)–কে পাঠানো হয়েছিল। ওই সময়ে মূর্তিপূজার সূচনা হয়। আল্লাহর পথে আসতে লোকদের দাওয়াত দেন। রাসুল হিসেবে তাঁকে অস্বীকার করেন। আল্লাহ তাদের পানিতে ডুবিয়ে মারেন। সুরার ৬৫ থেকে ৭২ আয়াতে আদ জাতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহর ধ্বংসপ্রাপ্ত ছয়টি জাতির মধ্যে নুহ (আ.)-এর পরে আদ ছিল দ্বিতীয় জাতি। এরা ছিল খুবই দুর্ধর্ষ, শক্তিশালী, সুঠামদেহী। আদ ও সামুদ ছিল নুহ (আ.)-এর পুত্র সামের বংশধর । আল্লাহ তাদের প্রতি নবী হিসেবে হুদ (আ.)-কে প্রেরণ করেন। শিরক বর্জন করে তওহিদ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। অবাধ্যদের ওপর নেমে আসে ঘূর্ণিঝড়। এতে তারা ধ্বংস হয়।
সুরার ৭৩ থেকে ৭৯ আয়াতে সামুদ জাতির কথা এসেছে। আদ জাতির ধ্বংসের পরে সামুদ জাতির প্রতি সালেহ (আ.)-কে নবী হিসেবে প্রেরিত হন। আদ ও সামুদ জাতি একই ব্যক্তি ইরামের দুই ছেলের দুটি বংশধারার নাম। সালেহ (আ.) তাদের মূর্তিপূজাসহ যাবতীয় কুসংস্কার ত্যাগ করে এক আল্লাহকে ভয়, তাঁর ইবাদত ও তাঁর প্রেরিত রাসুলের আনুগত্য করার প্রতি আহ্বান জানান। লোকেরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল ইমান আনে, তবে এরা ছিল সমাজের দুর্বল ও সাধারণ মানুষ। অন্য দল কুফরি (ইমানের বিপরীত অবস্থান) করে, সালেহ (আ.)-এর প্রতি ইমান আনেনি। এ অবাধ্য লোকেরা ভূমিকম্পে মারা যায়।
৮০ থেকে ৮৪ আয়াতে আল্লাহ লুত (আ.) ও তাঁর জাতির কথা বলা হয়। লুত (আ.) ছিলেন ইবরাহিম (আ.)-এর ভাতিজা। আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে বহুত্ববাদের ইবাদত ও কুফরিতে লিপ্ত ছিল। সমকামিতায় তারা লিপ্ত ছিল। তারা লুত (আ.)–কে প্রত্যাখ্যান করে। পাথর বৃষ্টিতে তারা ধ্বংস হয়।
সুরার ৮৫ থেকে ৯৩ আয়াতে শুয়াইব (আ.) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মাদইয়ানবাসীকে হিদায়াতের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির মধ্যে পঞ্চম জাতি হল মাদইয়ান। তারা আল্লাহ ও মানুষ উভয়ের হক নষ্ট করত। তারাও ধ্বংস হলো।
১০৩ থেকে ১৬২ আয়াতে মুসা ও হারুন (আ.) এবং ফিরাউনের আলোচনা করা হয়েছে। মুসা (আ.)-এর তোতলামির কারণে তাঁর কাজে সহযোগী হিসেবে ভাই হারুন (আ.)-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়। ফিরাউন নিজেকে রব দাবি করে। সে এবং তার দল সমুদ্রে ডুবে মরে। সুরা আল-আরাফের শেষ আয়াতটি সিজদার আয়াত।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ‘কোনো আদম সন্তান যখন কোনো সিজদার আয়াত পাঠ করে এরপর সিজদায়ে তিলাওয়াতে সম্পন্ন করে, তখন শয়তান কাঁদতে কাঁদতে পালিয়ে যায় এবং বলে যে আফসোস, মানুষের প্রতি সিজদার হুকুম হলো আর সে তা আদায়ও করল, ফলে তার ঠিকানা হলো জান্নাত, আর আমার প্রতিও সিজদার হুকুম হয়েছিল, কিন্তু আমি তার নাফরমানি করেছি বলে আমার ঠিকানা হলো জাহান্নাম ।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৩৩)