বদর মদিনা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরের একটি কুয়ার নাম। কুয়াটির নামে সেখানে একটি গ্রামও আছে। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এখানে। সেটি ছিল মুসলমানদের প্রথম ও প্রধান যুদ্ধ। বদর যুদ্ধের বিজয়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল অনেক বেশি।
বদরের যুদ্ধে সাহাবি ছিলেন মাত্র ৩১৩ জন। মুসলমান বাহিনীর সেনাপ্রধান ছিলেন স্বয়ং নবীজি (সা.)। কুরাইশদের সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ১০০০ জন—৭০০ জন উষ্ট্রারোহী, ৩০০ জন অশ্বারোহী। কুরাইশ বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল।
হজরত উমর (রা.) বলেছেন, বদরের যুদ্ধে নবীজি (সা.) প্রতিপক্ষের বাহিনীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন। এর পর কিবলামুখী হয়ে দুই হাত উঁচু করে উচ্চৈঃস্বরে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, আল্লাহ, আপনি আমাকে যে ওয়াদা করেছেন, আমার জন্য তা পূরণ করুন। আল্লাহ, আপনি আমাকে যা প্রদানে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা প্রদান করুন। আল্লাহ, মুসলমানদের এই ক্ষুদ্র সেনাদল ধ্বংস করে দিলে পৃথিবীতে আপনার ইবাদত করার কেউ থাকবে না।
এক সময় নবীজি (সা.)–র কাঁধ থেকে চাদর পড়ে গেল। আবু বকর (রা.) কাছে এসে তাঁর কাঁধে চাদর তুলে দিয়ে পেছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আল্লাহর নবী আপনার দোয়া যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনার সঙ্গে যে ওয়াদা করেছেন, তা অচিরেই পূর্ণ করবেন।
আল্লাহ তাআলা একটি আয়াত অবতীর্ণ করলেন, ‘স্মরণ করো, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে কাতর প্রার্থনা করেছিলে, তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন (এবং বলেছিলেন), আমি তোমাকে সাহায্য করব এক সহস্র ফেরেশতা দিয়ে, যারা একের পর এক আসবে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ৯)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন যে সেদিন একজন মুসলমান সৈন্য তার সামনে থাকা একজন মুশরিককে ধাওয়া করছিলেন। এমন সময় তিনি তার মাথার ওপর থেকে বেত্রাঘাত ও অশ্বারোহীর আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি অদৃশ্য অশ্বারোহীকে বলছিলেন, হে হায়মুম (ফেরেশতার ঘোড়ার নাম), সামনের দিকে এগিয়ে যাও। এর পর সামনে থাকা মুশরিকটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পান, সে চিত হয়ে পড়ে আছে। ভালো করে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, তার নাকে ক্ষত এবং মুখমণ্ডলে আঘাতের চিহ্ন, যেন কেউ তাকে বেত্রাঘাত করেছে। আহত স্থানগুলো সবুজ রং ধারণ করেছে।
সেই মুসলিম আনসার ব্যক্তিটি নবীজি (সা.)–এর কাছে এই ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। নবীজি (সা.) বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। এই সাহায্য আসমান থেকে এসেছে। সেদিন মুসলিমরা সত্তরজনকে হত্যা এবং সত্তর জনকে বন্দী করেন।
ইবনে আব্বাস (রা.) আরও বলেছেন, যুদ্ধবন্দীদের আটক করা হলে নবীজি (সা.) তাদের সম্পর্কে আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.)-এর পরামর্শ চাইলেন। আবু বকর (রা.) বললেন, হে আল্লাহর নবী! তারা তো আমাদের চাচাতো ভাই এবং সগোত্রীয়। আমি মনে করি, তাদের কাছে থেকে আপনি মুক্তিপণ গ্রহণ করুন। এতে কাফেরদের চেয়ে আমাদের শক্তি বাড়বে। এমনও অসম্ভব নয় যে আল্লাহ তাদের ইসলাম গ্রহণের তৌফিক দেবেন।
এরপর নবীজি (সা.) বললেন, উমর, এ ব্যাপারে তোমার অভিমত কী?
উমর (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) আমি একমত নই। আবু বকর যা উচিত বলে মনে করছেন, আমি তা মনে করি না। আমার মনে হয়, আপনি তাদের আমাদের হস্তগত করুন। আমরা তাদের ঘাড় নিশ্চিহ্ন করে দেব। আকিলকে আলীর হাতে দিয়ে দিন। তিনি তার শিরশ্ছেদ করবেন। আর আমার বংশের অমুককে আমার কাছে অর্পণ করুন, আমি তার শিরশ্ছেদ করব। কেননা তারা হলো কাফিরদের মর্যাদাশালী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ।
নবীজি (সা.) অবশ্য আবু বকর (রা.)-এর পরামর্শই পছন্দ করলেন। উমর (রা.) যা বললেন, তা তিনি করেননি। পরের দিন উমর (রা.) নবীজির (সা.) কাছে এলে দেখলেন যে, নবীজি (সা.) এবং আবু বকর (রা.) উভয়েই কাঁদছেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আমাকে বলুন, আপনি আর আপনার সঙ্গী কাঁদছেন কেন? বিষয়টি শুনে আমিও কাঁদব ।
নবীজি (সা.) বললেন, ফিদিয়া বা মুক্তিপণ গ্রহণ করার কারণে তোমার সঙ্গীদের ওপর বিপদের কথা ভেবেইই কাঁদছি। আমার কাছে তাদের শাস্তি পেশ করা হলো এই গাছটির চেয়েও কাছে! গাছটি ছিল নবীজির নিকটে। গাছের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, এই গাছের চেয়েও কাছে তোমাদের ওপর সমাগত আজাব আমাকে দেখানো হয়েছে।
এরপর আল্লাহ এ আয়াত নাজিল করেন, ‘দেশে সম্পূর্ণভাবে শত্রু নিপাত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোনো নবীর পক্ষে সমীচীন নয়। তোমরা চাও পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান পরলোকের কল্যাণ। আল্লাহ্ তো শক্তিমান তত্ত্বজ্ঞানী। আল্লাহর পূর্ববিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ তার জন্য তোমাদের ওপর মহা শাস্তি পতিত হত। যুদ্ধে তোমরা যা লাভ করেছ তা বৈধ ও উত্তম ভেবে উপভোগ করো। আর ভয় করো আল্লাহকে। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সুরা আনফাল, আয়াত: ৬৭-৬৯)
এর ফলে আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য গনিমত হালাল করে দেন।