বিদায় হজযাত্রায় মহানবী (সা.)–র রাগের পেছনে
দশম হিজরি। বিদায় হজ সমাসন্ন। নবীজীবনের শেষ হজ আদায়ের উদ্দেশে মহানবি (সা.) তাঁর সব সহধর্মিনীকে নিয়ে যাত্রা করলেন।
পথিমধ্যে সাফিয়া (রা.)–র উট বসে পড়ল। তিনি কেঁদে ফেললেন। উটটি ছিল সুন্দর। তাঁর পছন্দেরও হয়ে থাকবে। নবীজির (সা.) তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। নিজ হাতে তাঁর অশ্রু মুছে দিলেন। তাতে সাফিয়া (রা.)–র কান্না আরও বেড়ে গেল। নবীজির (সা.) তাকে আর কাঁদতে মানা করছিলেন। বিষয়টা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে তিনি তাঁকে ধমক দিলেন। এর পরকাফেলার সবাইকে বললেন যাত্রা ক্ষান্তি দিতে। সবাই নেমে পড়ল।
নবীজি (সা.)–এর তাঁবু খাটানো হলো। তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। সেটি ছিল সাফিয়া (রা.)–র সঙ্গে কাটানোর দিন। সাফিয়া (রা.)–র মনে হলো, নবীজি (সা.) আসলে এমন জায়গায় যাত্রাবিরতি করতে চাননি। তার কারণেই এটি হলো। তিনি শঙ্কা বোধ করলেন। আয়িশা (রা.)–র কাছে গিয়ে বললেন, তুমি জানো, আল্লাহর রাসুলের কাছ থেকে পাওয়া আমার দিনটি আমি কখনো কোনো কিছুর বিনিময়ে বিক্রি করিনি। যা-হোক আজ আমার এই দিনটি তোমাকে দিয়ে দিলাম।
আয়িশা (রা.) গায়ে চাদর জড়ালেন। জাফরানের রঙের নকশা করা সুবাস ছড়ানো চাদর। এগিয়ে গিয়ে নবীজি (সা.)–র তাঁবুর কিনারা তুলে ভেতরে তাকালেন। নবীজি (সা.) তাকে দেখে অবাক। বললেন, কী হলো আয়িশা, আজ তো তোমার দিন নয়? আয়িশা (রা.) বললেন, এটাই আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে খুশি তাকে দেন।
আবার যাত্রা শুরু হলো। নবীজি (সা.) জাইনাবকে বললেন, তোমার বোন সাফিয়াকে একটি উট ধার দাও। জাইনাব (রা.)–র উট ছিল সবার চেয়ে বেশি। জাইনাব বললেন, আমি একজন ইহুদিকে উট ধার দেব?
এ কথা শুনে নবীজির (সা.) খুব রাগ করলেন। মক্কায় পৌঁছানো পর্যন্ত জায়নাবের (রা.) সঙ্গে কথাই বললেন না। মিনায় কাটানো দিনগুলোতেও না। এক সময় মদিনায় ফিরে এলেন। মহররম ও সফর মাস পার হয়ে গেল। তিনি তাঁর কাছে আসেননি। তাঁর জন্য দিনও ভাগ করেননি। জাইনাব নিরাশ হয়ে রইলেন। অবশেষে রবিউল আউয়াল মাসে নবীজি (সা.) তার কাছে গেলেন। (আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, হাদিস: ৬২,৯০৯; আল ফাতহুর রাব্বানি, ২২/১৪২)
এই রবিউল আউয়াল মাসেই নবীজি (সা.) ইন্তেকাল করেন।
ইরাকের আম্বার বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিসের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রমজি খলিল সাফিয়া (রা.)–র বর্ণিত হাদিসের ওপর লেখা তার অভিসন্দর্ভে ‘মারাবিয়্যাত আস-সাইয়িদা সাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতাব ফি কুতুবিল হাদিস’ নামে এই হাদিসটির খুঁটিনাটি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন।
এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়।
প্রথমত, যাঁর কাছে চাওয়া হয়েছে এবং যাঁর জন্য চাওয়া হয়েছে, দুজনই নবীজি (সা.)–র সহধর্মিনী। সাফিয়া বিনতে হুয়াই (রা.) খাইবার যুদ্ধের বন্দি হয়ে আসেন। দাসী হিসেবে নবীজি (সা.)–র সামনে তাঁকে হাজির করা হয়। তাঁর বাবা ছিলেন সে সময়কার কুরাইজা ও নাজির নামে বিখ্যাত দুই ইহুদি গোত্রের নেতা। ইসলামের প্রতি অনুরাগ দেখে নবীজি (সা.) তাঁকে মুক্ত করে দেন এবং বিয়ে করেন।
দ্বিতীয়ত, আরবের খ্যাতিমান সিরাত বিশেষজ্ঞ সালেহ ইবনে আহমদ শামি বলেন, এই ঘটনার ‘সনদ’ বেশ শক্তিশালী। ইসলাম গ্রহণের পরে কাউকে ইহুদি (ইসলাম–বহির্ভূত কিছু) বলা মহাপাপ। এ-কারণেই জাইনাব (রা.) শাস্তির উপযুক্ত হয়েছেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, কেউ যেন কাউকে ফাসেক না বলে, কাফেরও নয়। কেননা বাস্তবে যদি সে তেমন না হয়ে থাকে তাহলে এই অপবাদের দায় তার দিকে ফিরে আসবে। (বুখারি, হাদিস: ৬,০৪৫)
কেন নবীজি (সা.) কথা বন্ধ রাখলেন ড. রমজি খলিল তার আরেকটা কারণ উল্লেখ করেছেন। তা হলো, নবীজি (সা.)–এর আদেশের পরেও উট না দেওয়ার মত প্রকাশ করা। যেমন সুরা আহজাবে (আয়াত: ৩৬) আছে, আল্লাহ ও তাঁর রসুল কোন বিষয নির্ধারণের পরে মুমিনের সেটা না করার অধিকার অবশিষ্ট থাকে না।