রিজিক নির্ধারিত হলে চেষ্টার কি প্রয়োজন আছে
ইমাম হুসাইন বিন আলী (রা.)-এর বিখ্যাত একটি বাণী আছে, ‘রিজিক নির্ধারিত। লোভীরা বঞ্চিত। কৃপণ নিন্দিত ও হিংসুক পীড়িত।’ (তাফসীরে রুহুল বয়ান, আল্লামা আবুল ফিদা ইসমাঈল হাক্কি (র.), খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৯৭)
রিজিকের পরিচয়
রিজিক আরবি শব্দ। আল্লামা ইবনে ফারিস (র.) তাঁর অভিধানে লিখেছেন, ‘সময় অনুযায়ী আসা দানকে রিজিক বলা হয়। এ ছাড়া রিজিক শব্দটি শুধু “দান” অর্থেও ব্যবহৃত হয়। রিজিক মানে হলো সময় অনুযায়ী প্রদান করা আল্লাহ তাআলার বিশেষ দান।’ (মাকায়িসুল লোগাহ, পৃষ্ঠা ৩৩৩) বিখ্যাত আরবি অভিধানপ্রণেতা আল্লামা আবু নসর জাওহারি (রহ.) লিখেছেন, ‘যার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হয়, তা-ই রিজিক।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘রিজিক মানে বিশেষ দান।’ (আস সিহাহ, পৃষ্ঠা ৪৪০)
আল্লামা ইবনে মানজুর (র.) লিখেছেন, ‘রিজিক দুই প্রকার: ১. দেহের জন্য রিজিক হলো খাদ্য। ২. অন্তর ও আত্মার জন্য রিজিক হলো জ্ঞান।’ (লিসানুল আরব, ইবনে মানযুর, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৩৯)
প্রতিটি প্রাণীর জীবনধারণের জন্য আল্লাহ–তাআলার এমন বিশেষ দানকে রিজিক বলা হয়, যা নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী প্রদান করা হয়; আর তার মাধ্যমে প্রাণীটির সার্বিক উপকার সাধিত হয়। রিজিক সেটাই, যা বান্দার উপকারে আসে। উপকারে আসার বিষয়টিও ব্যাপক—ইহকাল ও পরকাল তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কোনো ব্যক্তি মানুষ বা প্রাণী যদি ইহকালে রিজিকপ্রাপ্ত না হয়, পরকালে সে অবশ্যই তা পাবে। অনুরূপভাবে যা কিছু মানবদেহ ও আত্মার খোরাক মেটায়, তা-ই রিজিক। মোট কথা, আল্লাহ–তাআলার এক বিশেষ অনুগ্রহের নাম রিজিক, যা তিনি মানুষসহ সব প্রাণীকে নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী দিয়ে থাকেন।
রিজিকদাতা কেবলই আল্লাহ
আল্লাহ–তাআলাই একমাত্র রিজিকদাতা। রিজিকের জিম্মাদারি একমাত্র তাঁর। তিনি ছাড়া আর কোনো রিজিকদাতা ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রিজিকদাতা। শক্তির আধার ও পরাক্রমশালী।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ৫৮)
আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ করেছেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহর।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬)
ওপরের আয়াতে এ কথা স্পষ্ট যে রিজিকদাতা একমাত্র আল্লাহ–তাআলা। তিনি ছাড়া আর কোনো রিজিকদাতা নেই। মানুষসহ সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব তাঁর জিম্মায়। হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি যথাযথভাবে ভরসা রাখো। তিনি তোমাদের সেভাবে রিজিক দান করবেন, যেভাবে তিনি পাখিদের দান করে থাকেন। পাখিরা সকালে খালি পেটে নীড় থেকে বের হয়, আর সন্ধ্যায় উদর পূর্ণ করে নীড়ে ফেরে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৩৪৪; ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪১৬৪)
তালাশ করার শর্তে রিজিক নির্ধারিত
প্রত্যেক মানুষের রিজিক নির্ধারিত। একজন মানুষ যা কিছু পান বা লাভ করেন, পূর্বনির্ধারিত ছিল বলে তিনি তা পেয়ে থাকেন। যা কিছু মানুষ পান না বা লাভ করেন না, নির্ধারিত ছিল না বলেই তিনি তা পাননি বা লাভ করেননি। নির্ধারিত রিজিকে কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। কেউ এক মুঠো বেশি রিজিক পাবেন না, এক মুঠো কমও পাবেন না। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের পৃথিবীতে ঠাঁই দিয়েছি এবং তোমাদের জন্য তাতে রেখেছি জীবনোপকরণ। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ১০)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আপন আপন মাতৃগর্ভে তোমরা প্রত্যেকেই চল্লিশ দিন পর্যন্ত (শুক্র হিসেবে) জমা ছিলে। তারপর চল্লিশ দিন রক্তপিণ্ড হিসেবে, এরপর চল্লিশ দিন গোশতের পিণ্ড হিসেবে জমা ছিলে। এরপর আল্লাহ–তাআলা একজন ফেরেশতা পাঠান এবং বান্দার রিজিক, মৃত্যু, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য—এ চারটি বিষয় লেখার আদেশ প্রদান করেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৬৫৯৪)
রিজিক আল্লাহ–তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত। তার তালাশ করা বা অনুসন্ধান করা বান্দার দায়িত্ব। রিজিক আল্লাহ–তাআলার হাতে, চেষ্টা বান্দার হাতে। আল্লাহ–তাআলা রিজিক নির্ধারণ করে রেখেছেন বলে তার মানে এই নয়, সে রিজিক আপনা–আপনি আমাদের কাছে এসে হাজির হবে। আকাশ থেকে রিজিক নাজিল হবে, আর বান্দা কেবল তা গ্রহণ করে ধন্য হবে। আল্লাহ–তাআলার ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে প্রয়োজন ও চাহিদা অনুয়ায়ী রিজিক অনুসন্ধান করতে হবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা জুমআ, আয়াত: ১০)
মুত্তালিব ইবনে হানতাব (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় জিবরাইল (আ.) আমার অন্তরে অহি ঢেলে দিয়েছেন, অবশ্যই রিজিক শেষ হওয়ার আগে কারও মৃত্যু হয় না। সুতরাং তোমরা হারাম ছেড়ে হালাল পথে রিজিকের অনুসন্ধান করো।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ২৫৪)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)–র বর্ণনায় আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা দ্বীনের ফরজগুলোর পর অন্যতম ফরজ।’ (সুনানুল কুবরা, বাইহাকি, খণ্ড ৬, হাদিস: ১১,৬৯৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘হে মানুষ! আল্লাহ–তাআলাকে ভয় করো এবং উত্তম ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় রিজিক অনুসন্ধান করো। কারণ, কোনো প্রাণী তার জন্য বরাদ্দকৃত রিজিক প্রাপ্ত না হয়ে মৃত্যুবরণ করবে না। যদিও রিজিক লাভ করাটা তার জন্য বিলম্বিত হয়। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় রিজিক তালাশ করো। যা হালাল, তা গ্রহণ করো; যা হারাম, তা পরিত্যাগ করো।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২,১৪৪)
মিরাজ রহমান: লেখক ও গবেষক