তাঁর চমৎকার বাগ্মিতার কারণে খতিবুল আম্বিয়া বলা হয়
হজরত শোয়াইব (আ.)-এর কওম যেখানে বসবাস করত, সেটা ছিল একটি পাহাড়ি উপত্যকা। চারদিকে পাহাড়-পর্বত। মাঝখানে সমতল ভূমি। চারদিকে প্রাচীরবেষ্টিত ছিল তারা। তাতে ছিল বিশালকায় প্রবেশদ্বার। এখনো সে স্থানে কওমে শোয়েবের ঘরবাড়ির কিছু বিশেষ নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। তবে তারা ঘর নির্মাণ করত পাথুরে পাহাড়ের গা খোদাই করে। একটির পর একটি আলাদা আলাদা ঘর। একটি ঘরের ভেতর চারটি বা পাঁচটি ছোট খোপ থাকত। আর সামনে একটি বড় অলিন্দ। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার জন্য ছিল বড় সুড়ঙ্গ বা গর্তের মতো সরু পথ। সবখানে সহজে বাতাস চলাচলের সুবিধার্থে পাথর কেটে ফোকর বা জানালার ব্যবস্থা করে রাখত তারা। আর তারা মানুষকে কবর দিত সারিবদ্ধভাবে পরিখার মতো খুদে পরিসরে। একেকটি পরিখায় একেকজন মানুষ শুতে পারত। বাড়ির সামনের দেয়ালে তারা কিছু নকশা ও কারুকাজের চিহ্নও দিয়ে রাখত শিল্পিত হাতে। আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে সেসব চিত্রকর্ম।
হজরত শোয়াইব (আ.)–কে তাঁর চমৎকার বাগ্মিতার কারণে ‘খতিবুল আম্বিয়া’ বলা হয়। এ ছাড়াও তিনি তাদের নানান সংযম, সহনশীলতা ও মমতার সঙ্গে সব বুঝিয়েছেন। কিন্তু বিনিময়ে কেবল উপহাস-পরিহাসই পেয়েছেন। অবশেষে তারা যখন সীমা লঙ্ঘন করল, তখন আল্লাহ–তাআলার গজব এসে গেল।
তাফসিরকারকেরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে তাদের ওপর তিন ধরনের আজাব হয়েছিল। এক. ঘন মেঘমালা থেকে অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল। দুই. এর পর প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায়। তিন. সবশেষে ভূমিকম্প হয়। এ ব্যাপারে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হজরত শোয়াইব (আ.)-এর জাতির ওপর এমন গজব চাপিয়ে দেওয়া হয়, যেন জাহান্নামের দরজা তাদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল।
কয়েক দিন তাদের অঞ্চলে প্রচণ্ড গরম পড়ল। একদিন দুপুরে গরমে তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হতে থাকে। তখন ছায়া ও পানি কোথাও তাদের স্বস্তি ছিল না। অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের কেউ নিজেদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে, কেউ জঙ্গলে আশ্রয় নিল। কিন্তু দেখতে পেল সেখানে আরও গরম। কাছের একটা ময়দানের ওপর গাঢ় মেঘমালা দেখা দিল। তারা ছটফট করতে করতে সেই ময়দানের দিকে ছুটে চলল। দেখল, সেখানে মেঘের ছায়া, আর নিচে শীতল বাতাস বইছে। সবাই গরমে অস্থির হয়ে মেঘের নিচে এসে আশ্রয় নিল। কিন্তু সেটি যে বিধ্বংসী মেঘ ছিল, তারা তা জানত না। তারা বলতে লাগল, এই মেঘ থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে। কিন্তু আল্লাহর আদেশ এল এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের মহাগর্জন আঘাত করল। সঙ্গে ঘন কালো মেঘ আগুনে রূপান্তরিত হয়ে তাদের ওপর বর্ষিত হলো। আর নিচের দিকে শুরু হলো প্রচণ্ড ভূমিকম্প।
ওরা নিজেদের ঘরে-জঙ্গলে যে যেখানে ছিল, সেখানেই এমনভাবে উপুড় হয়ে শেষ হয়ে গেল, যেন তারা সেখানে কখনো বসবাস করেনি। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে শোয়াইব (আ.) এবং তাঁর কথায় যাঁরা ইমান এনেছিলেন, তাঁরা বেঁচে গেলেন। বরং এই ধ্বংসের সময় শোয়েব (আ.) তাঁর নিজগৃহেই অবস্থান করছিলেন। তিনি যখন তাঁর সম্প্রদায়ের এ পরিণতি লক্ষ করলেন, তখন তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এরপর তিনি ওই এলাকা থেকে এ কথা বলে চলে গেলেন যে, হে আমার কওম, আমি তোমাদের কাছে আমার রবের বাণী পৌঁছে দিয়েছি। তোমাদের মঙ্গল কামনার হকও আদায় করেছি। এখন যে কাওম সত্য কবুল করতেই অস্বীকার করে, তার জন্য আমি কী করে আফসোস করি? (সুরা আরাফ, আয়াত: ৯৪)
হেজাজ থেকে তাবুকে বা সিরিয়া যাওয়ার পথে হাজারমাওতে একটি সমাধি রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই সেটি সর্বসাধারণের দর্শনীয় স্থান। স্থানীয় অধিবাসীদের মতে সেটাই শোয়াইব (আ.)-এর কবর। তাঁদের মতে, আইকাবাসীরা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে হজরত শোয়াইব (আ.) এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। এখানেই তিনি তিরোহিত হন। এর বর্তমানে সঠিক স্থান হিসেবে বলা হয়, হাজারামাওতের বিখ্যাত শহর শাইউনের পশ্চিম দিকে শাবান নামে যে জায়গাটি রয়েছে, সেখান থেকে ‘ওয়াদিয়ে ইবনে আলী’ অবস্থিত, তার থেকে উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওয়াদি পা হলেই সমাধিটি পাওয়া যাবে। আশপাশে এখন আর কোনো বসতি চোখে পড়ে না। তবে স্থানটি দর্শনার্থীদের আগমনে সব সময়ই গুলজার থাকে।