ইমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মতে, ইমানের যাবতীয় স্তর বা রোকনের ওপর অন্তরের বিশ্বাস স্থাপন করাই হলো ইমান। মৌখিকভাবে স্বীকারোক্তি দেওয়াও ইমানের শর্ত। বাহ্যিক আমল ইমানের মৌলিক রোকন নয়, তবে ইমানের পূর্ণতার জন্য আবশ্যক। (শারহুল ফিকহিল আকবর, ইমাম আজম আবু হানিফা, অনুবাদ: এনামুল হক মাসউদ, মাকতাবাতুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা ৪৬২)
আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘যেসব মানুষ ইমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তারা জান্নাতবাসী। তারা সর্বদা সেখানে থাকবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৮২) অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, আয়াতে উল্লিখিত সৎকর্ম মানে যাবতীয় ভালো কাজসহ আমল-ইবাদত।
ইমান মুমিনের সবচেয়ে বড় পরিচয়, শ্রেষ্ঠ অর্জন। ইমান আনার পর তা ভেঙে যাওয়া মানে ইমান নষ্ট হয়ে যাওয়া। ইমান ভেঙে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তখন আবার তাওবা করে ইসলাম গ্রহণ আবশ্যক হয়ে ওঠে।
ইমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণগুলো নিচে দেওয়া হলো:
১. আল্লাহর সঙ্গে কারও শরিক করা
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান উপাস্য বা ইলাহ হিসেবে বা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্য স্থির করো না।’ (সুরা ইসরাইল, আয়াত: ২২)
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুরা নিসার ৪৮, সুরা মায়িদার ৭২, সুরা আনআমের ৮২, সুরা শুআরার ৯৭-৯৮, সুরা জুমারের ৬৫, সুরা তাওবার ৫, সুরা ইউনুসের ১৮ এবং সুরা আনকাবুতের ৬৫: আয়াতেও এ ধরনের আলোচনা রয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহকে (সা.) আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোন অপরাধটি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করবে অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। (বুখারি, হাদিস: ৩৩৬০, মুসলিস, হাদিস: ১২৪)
২. আল্লাহ ও বান্দার মাঝখানে কাউকে মাধ্যম বানানো
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান আল্লাহকে ডাকা বা তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে কোনো মাধ্যম গ্রহণ করেন এবং সে মাধ্যমকে শাফায়াতের যোগ্য মনে করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘বলুন! সমস্ত সুপারিশ একমাত্র আল্লাহর আওতাধীন। আসমান ও জমিনে তাঁরই সাম্রাজ্য। (সুরা জুমার, আয়াত: ৪৪)
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুরা জুমারের ৩, সুরা ইউনুসের ১৮, সুরা সাবার ২২-২৩, সুরা মরিয়মের ৮১-৮২, সুরা শুআরার ১০০-১০১, সুরা আম্বিয়ার ২৮ এবং সুরা বাকারার ২৫৫: আয়াতেও আলোচনা রয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ–তাআলার কাছে প্রার্থনা করে না, তিনি তার ওপর রাগান্বিত হন।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩৩৭৩)
৩. কাফির-মুশরিকের মতবাদকে সঠিক মনে করা
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান কাফির বা মুশরিককে কাফির–মুশরিক মনে না করেন এবং তাদের মতবাদকে সঠিক মনে করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আহলে কিতাবিদের মাঝে যারা কুফরি ও শিরক করে; তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামি এবং তারাই সৃষ্টির মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি। (সুরা বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৬)
এ ছাড়া এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৩০-২৫৫, মুমতাহিনার ৪: আয়াতে আলোচনা রয়েছে।
আবু মালিক (রা.)-এর পিতা বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলল এবং আল্লাহর ছাড়া বাকি সব উপাস্যকে অস্বীকার করল, তার সম্পদ ও রক্ত অন্য মুসলিমের জন্য নিষিদ্ধ। আর তার প্রকৃত হিসাব-নিকাশ আল্লাহর দায়িত্বে। (মুসলিম, হাদিস: ২৩)
৪. রাসুলুল্লাহ (সা.) আনা আদর্শ ছাড়া অন্য কোনো আদর্শকে উত্তম মনে করা
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান রাসুলুল্লাহ (সা.) আনীত জীবনবিধান বা হুকুমত বা আদর্শ ছাড়া অন্য কোনো জীবনবিধান বা হুকুমত বা আদর্শকে উত্তম মনে করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো কাজের আদেশ করলে, কোনো ইমানদার নারী-পুরুষের জন্য সে বিষয়ে ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো অধিকার নেই। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশ অমান্য করে, সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ৩৬)
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুরা নাজমের ৩-৪, সুরা মায়িদার ৩-৪৪, সুরা আলে ইমরানের ৮৫, সুরা আনআমের ৫৭ এবং সুরা নিসার ৬০-৬৫: আয়াতেও আলোচনা আছে।
জাবির (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সবচেয়ে উত্তম আলোচনা হলো আল্লাহর কিতাব এবং সবচেয়ে উত্তম আদর্শ হলো মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদর্শ। (মুসলিম, হাদিস: ৮৬৭)
৫. শরিয়তের কোনো অংশকে অপছন্দ বা অস্বীকার করা
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান ইসলামি জীবনবিধান বা শরিয়ত অনুসরণ করার পর এ জীবনবিধান বা শরিয়তের কোনো অংশকে অপছন্দ বা অস্বীকার করেন তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আর যারা কাফির তাদের জন্য রয়েছে দুর্গতি এবং তিনি (আল্লাহ) তাদের কর্ম বিনষ্ট করে দেবেন। এটা এ জন্য যে আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তারা তা অপছন্দ করে। সুতরাং আল্লাহ তাদের নিষ্ফল করে দেবেন’ (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৮-৯)
আল্লাহ–তাআলা আরও ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২০৮)
৬. শরিয়তের কোনো সওয়াব বা শাস্তির বিধান নিয়ে ঠাট্টা করা
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান ইসলামি শরিয়তের কোনো সওয়াবের বা শাস্তির বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আপনি বলুন! তোমরা কি আল্লাহর সঙ্গে তাঁর হুকুম-আহকামের সঙ্গে এবং তাঁর রাসুলের সঙ্গে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছিলে? ছলনা কোরো না। ইমান আনার পর তোমরা কাফির হয়ে গেছ।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৬৫-৬৬)
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুরা জাসিয়ার ৯, সুরা ফুরকানের ৪১-৪২, মুতাফফিফীনের ২৯-৩৩ এবং আলে ইমরানের ১০৬: আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।
এক ব্যক্তির ঠাট্টা-মশকরার জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তাদের বলো! তোমাদের হাসি-তামাশা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত এবং তাঁর রাসুলের সঙ্গে ছিল? এখন আর ওজর পেশ কোরো না। তোমরা ইমান আনার পর কুফুরি করেছ।’ (তাফসিরে তারাবি, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ১৭২)
৭. জাদু বা তন্ত্র-মন্ত্রের প্রয়োগে কিছু করার চেষ্টা
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান জাদুর মাধ্যমে ভালো কিছু অর্জন ও মন্দ কিছু বর্জন করেন এবং প্রকাশ্য ও গোপন তন্ত্র-মন্ত্র বা জাদুর মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি সাধন করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘কিন্তু শয়তানরাই কুফুরি করেছিল এবং তারা মানুষকে জাদু শিক্ষা দিত। তারা ভালোভাবেই জানে, যে জাদু অবলম্বন করে; পরকালে তার কোনো অংশ নেই।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১০২)
এ ছাড়া এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের সুরা ত্বহার ৬৬, সুরা নামলের ৬৫: আয়াতে আলোচনা আছে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ধ্বংসাত্মক সাতটি কাজ বা বস্তু থেকে বেঁচে থাকো। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করল, সেগুলো কী? রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, জাদু করা।’ (বুখারি, হাদিস: ২৭৬৬, মুসলিম, হাদিস: ৮৯)
৮. মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফির বা মুশরিকদের সাহায্য করা
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান কোনো কাফির বা মুশরিককে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা করেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা তাদের (বিধর্মী) সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদের পথপ্রদর্শন করেন না।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৫১)
এ ছাড়া এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের সুরা নিসার ১৩৮-১৩৯, সুরা মায়েদার ৬২-৬৩, সুরা হাশরের ১১, সুরা নাহলের ১০৭ এবং সুরা মুজাদালাহর ২২: আয়াতে আলোচনা বিবৃত হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বিবেচিত হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪০৩১)
৯. ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো জীবনবিধান গ্রহণ বা সেটাকে উত্তম ভাবা
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান ইসলাম বা রাসুল (সা.) আনীত জীবনবিধান ছাড়া অন্য কোনো জীবনবিধান গ্রহণ করেন বা সেটাকে উত্তম ভাবেন, তাহলে তাঁর ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করবে, তার কোনো আমল গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫)
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুরা সাবার ২৮, সুরা আরাফের ১৫৮, সুরা ফুরকানের ১ এবং সুরা আলে ইমরানের ১৯: আয়াতেও আলোচনা রয়েছে।
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! এই উম্মতের কোনো ব্যক্তি, হোক সে ইহুদি বা নাসারা; যদি সে আমার আগমনের কথা শোনার পরও আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি তার ওপর ইমান না এনে মারা যায়, তাহলে সে জাহান্নামিদের দলর্ভুক্ত হবে।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৫৩)
১০. আল্লাহর মনোনীত দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া
যদি কোনো মুমিন-মুসলমান আল্লাহর মনোনীত দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তার ইমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহর আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশ প্রদান করা হয়। অতঃপর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তার চেয়ে জালিম আর কে হতে পারে? নিশ্চয়ই আমি (আল্লাহ) অপরাধীদের শাস্তি দেব। (সুরা সিজদাহ, আয়াত: ২২)
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে সুরা আহকাফের ৩, সুরা আলে ইমরানের ৩২, লাইলের ১৪-১৬ এবং সুরা নুরের ৪৭: আয়াতেও আলোচনা রয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের পরিবর্তে অন্য কোনো ধর্মের ওপর শপথ করবে, সে ওই ধর্মের অনুসারী বলে গণ্য হবে।’ (বুখারি, হাদিস: ১৩৬৪, মুসলিম, হাদিস: ১১০)