পশ্চিমা পণ্ডিতদের দৃষ্টিতে মহানবী (সা.)

পশ্চিমা লেখকগণ চৌদ্দ শতকে প্রথম মহানবী (সা.)-কে উপজীব্য করে লিখেছেন বলে জানা যায়। ‘পিয়ার্স দ্য প্লাউম্যান’ নামে ১৩৭০ সালে উইলিয়াম ল্যাংলান্ড নবীজিকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখেছেন। তাতে লিখেছেন, ‘মুসলিমরা যাকে তাদের মেসিহা মনে করত, তার নাম মাকামেদ, তিনি ছিলেন একজন খ্রিষ্টান কার্ডিনাল। ১৬৪৯ সালে সিউর ডিউ রায়ার লিখেছেন আলকোরান অব মোহামেট। এই মোহামেট হলো মুহাম্মদ (সা.)-এর বিচ্যূত রূপ। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে একই নামের ৪১টি রূপের সন্ধান পাওয়া যায়।

এর পর কয়েক শতাব্দী ধরে পশ্চিমা গবেষকেরা অজস্র গ্রন্থ রচনা করেছেন ইসলাম ও মহানবী(সা.)কে কেন্দ্র করে। তবে ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই সব গবেষণার বেশির ভাগই পক্ষপাতমূলক, গোঁড়া, নেতিবাচক ও আক্রমণাত্মক। একুশ শতকে এসে তাদের গবেষণা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ শতক থেকেই ধীরে পশ্চিমাদের চিন্তাধারায় একটি ইতিবাচক ধারণা লক্ষ্য করা যায়। এ সময়ে জার্মান গবেষক গুস্তাফ ওয়েইল, অস্ট্রিয়ান রচয়িতা স্প্রেঙ্গার, স্কটিশ লেখক উইলিয়াম মুর কিংবা আর ভি সি বোদলের মতো লেখকেরা—খ্যাতিমান পণ্ডিত আলি নদভি যাঁদের বলেছেন ‘ইনসাফগার’—তাঁদের রচনা আমরা দেখতে পাই।

আরও পড়ুন

ইংরেজি ভাষায় মহানবী (সা.)-এর জীবনীর আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক আবদুর রহিম কিদওয়াই একটি বিশদ গ্রন্থ রচনা করেছেন, নাম ইমেজেস অব দ্য প্রফেট মুহাম্মাদ ইন ইংলিশ লিটারেচার (২০১৮)। তিনি পশ্চিমা পণ্ডিতদের নবীজীবন চিত্রায়ণের সমগ্র প্রকল্পকে সংক্ষেপে এভাবে বলেছেন, ‘শতাব্দীকাল ধরে পশ্চিমাদের নবীজীবনী রচনায় অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয় চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে সত্য, তবে স্বস্তির কথা হলো, বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে পশ্চিমে মহানবী (সা.)-এর প্রতি খানিকটা ন্যায্যতা এসেছে। অনেক পণ্ডিত পূর্বসূরিদের অন্যায্য অন্যায় ও শত্রুতার কথা স্বীকারও করেছেন। সুতরাং আমরা পশ্চিমের সেই সকল গুণী লেখকের নবীজীবনীকে স্বাগত জানাই, যারা মহানবী (সা.)-এর কীর্তিগাথা ও নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যের প্রতি অনেকাংশে ন্যায়বিচার করেছেন।’

কিদওয়াইর গ্রন্থটি বিশ শতকের পশ্চিমা সিরাতকার রচনা ও নির্মাণে সীমাবদ্ধ। পশ্চিমা অমুসলিম গবেষক ও লেখকদের একুশ শতকের কয়েকটি রচনা নিয়ে আলাপ করব, যেখানে মুহাম্মাদ (সা.)-কে ন্যায়নিষ্ঠভাবে চিত্রিত করা হয়েছে।

ফলোয়িং মুহাম্মাদ: রিথিংকিং ইসলাম ইন দ্য কন্টেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড (২০০৩) বইটির লেখক অধ্যাপক কার্ল ডব্লিউ. আর্নস্ট (জন্ম ১৯৫০)। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চ্যাপেল হিলের উত্তর ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউএনসি) ‘সেন্টার ফর ইসলামিক অ্যান্ড মিডল ইস্ট স্টাডিজ’–এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। বইটি ইউএনসি প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয় এবং ব্যাপক সমাদর লাভ করে। ২০০৪ সালে বইটি কুয়েতের মর্যাদাবান ‘বাশরাহিল প্রাইজ’ জিতে নেয় এবং ইউএনসি গত ১০০ বছরে তাদের প্রকাশিত সেরা ১০ বইয়ে তালিকাভুক্ত করে। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘যদিও কোরআন একটি খোদায়ি প্রকাশ বলে ইসলামি ঐতিহ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস, কিন্তু নবী মুহাম্মাদ (সা.) না হলে তা আমরা বর্তমান রূপে পেতাম না। ১৪০০ বছর আগে অকল্পনীয় উপায়ে নৈতিকতা, আইন, পারিবারিক জীবন, রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার জন্য জীবন্ত আদর্শ হিসেবে কাজ করেছেন। ইতিহাসে খুব কম লোকই মানববতায় প্রবলভাবে প্রভাব রেখেছে, ঐতিহাসিক বিবরণের মধ্য দিয়েই প্রভাবটি আমাদের বুঝতে হবে।’

আরও পড়ুন

বিস্ময়কর প্রভাব

লেখক গেরহার্ড বোওয়ারিং (জন্ম ১৯৩৯) একজন জার্মান একাডেমিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইসলাম অধ্যয়ন’ বিভাগে অধ্যাপনা করেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ৬৬৫ পৃষ্ঠার বিশ্বকোষ সম্পাদনা করেন। ‘ইসলামিক পলিটিক্যাল থট: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন’ প্রবন্ধে তিনি নবীজি (সা.)-কে একজন ‘রাজনৈতিক নেতা’ আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, ‘একজন মানুষ এত অল্প সময়ে কীভাবে এত বিশাল অর্জন আয়ত্ত করতে পারেন, তা বিস্ময়কর।…এক সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে তিনি একটি বিশ্বে প্রভাব বজায় রাখছেন এবং তাঁর বার্তা আজও বিশ্বব্যাপী আকর্ষণ সৃষ্টি করছে। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে তার কথামালা পরীক্ষিত হয়েছে এবং তাঁর অনুসৃতি জাতির সদস্যসংখ্যা শতাব্দীকাল ধরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

মানবতার আদর্শ

লেখক তামারা সোন (জন্ম ১৯৪৯) একজন আমেরিকান শিক্ষাবিদ এবং জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম ও ধর্মবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। ইসলাম: আ ব্রিফ হিস্ট্রি তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ। বইয়ে ‘দ্য এক্সাম্পলারি লাইভ অব মুহাম্মাদ’ শিরোনামে তিনি বলেছেন, ‘নবী মুহম্মাদ (সা.)-র ভূমিকা কেবল প্রত্যাদেশ ছড়িয়ে দেওয়াতে সীমাবদ্ধ ছিল না’, বরং তাঁর জীবন ‘মানবতার জন্য একটি আদর্শ। কীভাবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যাপন করতে হয় এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তে আল্লাহর ইচ্ছাতে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়, তার নমুনা তিনি। কোরআন তার জীবনকে ইসলামের সেরা উদাহরণ সাব্যস্ত করেছে।’ (সুরা আল-আহজাব ২১)। কোরআনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সুন্নাহ ‘মুসলিমদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে ন্যায়নিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা’।

আরও পড়ুন

জীবন্ত কোরআন

লেখক জন এল এসপসিতো (জন্ম ১৯৪০) খুবই জনপ্রিয় একজন গবেষক। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইসলাম ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক অধ্যাপক। তিনি একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান এবং সৌদি প্রিন্স ওয়ালিদ বিন তালালের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সেন্টার ফর মুসলিম-ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারস্ট্যান্ডিং’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। ফিলাডেফিয়ার টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রভাবশালী মুসলিম স্কলার ইসামাইল রাজি আল-ফারুকির (মৃত্যু ১৯৮৬) অধীনে ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন।

তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, ‘মুসলিমরা মুহাম্মাদ (সা.)-কে একজন নবী এবং একজন অত্যন্ত মানবিক চরিত্র-সম্পন্ন হিসেবে দেখেন; যিনি একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টিতে সমৃদ্ধ ছিলেন। অথচ খ্রিষ্টানদের দৃষ্টিতে নবী ঈসা (আ.) কেবল আধ্যাত্মিক প্রকৃতি। মুসলিমরা মুহাম্মাদ (সা.)-র উদাহরণ থেকে জীবনের সকল দিকের নির্দেশনা গ্রহণ করেন। কীভাবে বন্ধু ও শত্রুর সঙ্গে আচরণ করতে হয়, কী খেতে ও পান করতে হয়, কীভাবে শোক প্রকাশ ও উদ্‌যাপন করতে হয়—সব। মুহাম্মাদ (সা.) কোরআনে প্রকাশিত নির্দেশনাগুলি জীবনকর্মে রূপান্তর করে দেখিয়েছেন।...তিনি ছিলেন “জীবন্ত কোরআন”। ইসলামে জীবনের কোনো দিক তাই ধর্মের বাইরে নয়। বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম মহান চরিত্র। তিনি আরব জীবনে একটি বিপ্লব নিয়ে এসেছিলেন, যা তাদের জীবনধারাকে বিশুদ্ধ ও পুনর্গঠিত করতে চেয়েছে।’

নবী, রাজনৈতিক নেতা, নৈতিক আদর্শ

লেখক উইলিয়াম ই শেপার্ড (জন্ম ১৯৩৩) নিউজিল্যান্ডের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ। ক্রাইস্টচার্চের ইউনিভার্সিটি অব ক্যান্টারবারির ধর্ম বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর বইয়ে ‘নবী মুহাম্মাদ (সা.): সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম’ শিরোনামে সম্পূর্ণ অধ্যায় রেখেছেন। সূচনা করেছেন এভাবে, যদি কোরআন আল্লাহর কিতাব হয়, তবে মুহাম্মাদ (সা.) হলেন সেই ব্যক্তি, যাঁর মাধ্যমে সেই কিতাব মানবজাতির কাছে এসেছে। তাঁর কথা ও কাজ হলো সেই কিতাবের অগ্রগণ্য ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন একাধারে নবী, সালিস, রাজনৈতিক নেতা এবং নৈতিক আদর্শ। তারপর বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ (সা.)-কে একজন সংস্কারক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যিনি তাঁর সময়ের আরবদের সামাজিক ও নৈতিক মানের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটিয়েছেন… তিনি তাঁর অনুসারীদের মধ্যে সমতা ও পারস্পরিক দায়িত্বশীলতার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বিশেষ শ্রেণির বিশেষ সুবিধা কিংবা সম্পদের চরম সীমা বিলোপ করতে বলেছেন। তাঁকে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।’

এসব বই মহানবীর (সা.)জীবন সম্পর্কে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পশ্চিমা পণ্ডিতদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এবং পূর্বেকার প্রাচ্যবিদদের থেকে তাদের একটি বিস্ময়কর ব্যবধান স্পষ্ট করে তোলে। মহানবীর (সা.)মহত্ত্ব ও কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

আরও পড়ুন