আজ খতমে তারাবিতে পবিত্র কোরআনের সুরা মুজাদালা, সুরা হাশর, সুরা মুমতাহিনা, সুরা সাফ, সুরা জুমা, সুরা মুনাফিকুন, সুরা তাগাবুন, সুরা তালাক ও সুরা তাহরিম তিলাওয়াত করা হবে। ২৮তম পারা পড়া হবে। আজকের তারাবিতে তালাক, পারিবারিক ও বৈবাহিক জীবন, স্ত্রীর ভরণপোষণ, বৈঠকের আদব, আনসারদের সুসংবাদ, কাফেরদের সঙ্গে মুসলমানদের আচরণনীতি, নবীজির গুণাবলি, আজান হলেই জুমার নামাজে যাওয়া, মানুষের বিভক্তি ও আল্লাহর পথে ব্যয়, দুনিয়ায় নারীর জান্নাতের সুসংবাদ, আল্লাহ এবং শয়তানের দল, কানাঘুষা, আল্লাহর প্রশংসা, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী, ইহুদি সম্প্রদায়, রিসালাতের উদ্দেশ্য, কাফেরদের পরিণতি, ইবাদতের জন্য মুমিনের আফসোস, কৃপণতা ইত্যাদি বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে।
যে নারীর কথা আল্লাহ শুনলেন
২২ আয়াতবিশিষ্ট সুরা মুজাদালাহ মদিনায় অবতীর্ণ। মুজাদালাহ অর্থ ঝগড়া। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে খাওলা (রা.) তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে এমন স্বরে অভিযোগ করেছিলেন, যেন তিনি ঝগড়া করছেন। তাই এর নাম রাখা হয়েছে সুরা মুজাদালাহ।
খাওলা (রা.)-এর স্বামী ছিলেন আওস ইবনে সামেত। আওস খাওলাকে বললেন, ‘তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মতো,’ অর্থাৎ, ‘তোমাকে আমার জন্য আমার মায়ের মতো হারাম করলাম।’ ইসলাম–পূর্ব যুগে এই বাক্য ছিল তালাকের চেয়েও কঠোর।
খাওলা চিন্তায় পড়ে ছুটে গেলেন নবীজি (সা.)-র কাছে। কিন্তু কোনো সমাধান পেলেন না। নবীজি (সা.)-কে তখনো এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। তিনি নবীজি (সা.)-র সঙ্গে কথা বাড়াতে লাগলেন, যেন ঝগড়া করছেন।
পরে খাওলা কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন। আল্লাহ তাঁর কথা শুনে এর সমাধান দিয়ে সুরা মুজাদালার ১ থেকে ৫ নম্বর আয়াত নাজিল করলেন। বিধান দেওয়া হলো, স্ত্রী চিরতরে হারাম হয় না। তবে কাফফারা আদায় করতে হবে। কাফফারা হলো ধারাবাহিকভাবে দুই মাস রোজা রাখা বা ৬০ জন অসহায় ব্যক্তিকে খাওয়ানো।
সুরা হাশরে ইহুদিদের কথা
২৪ আয়াতবিশিষ্ট সুরা হাশর মদিনায় অবতীর্ণ। হাশর অর্থ দেশান্তর। এ সুরায় তৎকালীন মদিনার ইহুদিদের দেশান্তর করার আলোচনা রয়েছে, তাই এর নাম হাশর রাখা হয়েছে।
ইবনে ইসহাক বলেন, ‘সুরা হাশর ইহুদি বনু নজির গোত্র সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।’ (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ১৩৪৯) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এ সুরার নামই ‘সুরা বনু নজির’ বলতেন। (ইবনে কাসির) আল্লাহর প্রশংসা, অপরাধের কারণে বনু নজিরকে মদিনা থেকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গ, বিনা যুদ্ধে অর্জিত সম্পদের বণ্টননীতি, আনসারদের সুসংবাদ, মুনাফিকদের নিন্দা, তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহর পরিচয়সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে এ সুরায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে সকালে তিনবার ‘আউজুবিল্লাহিস সামিয়িল আলিমি মিনাশ শায়তানির রাজিম’ পড়ে সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পাঠ করে, আল্লাহ তার জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করেন; যারা তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকে। এ সময় সে মারা গেলে শহীদের মৃত্যু লাভ করবে। যে এটি সন্ধ্যায় পড়বে, তাহলে তার একই মর্যাদা রয়েছে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩০৯০)
বন্ধু গ্রহণের নীতিমালা
সুরা মুমতাহিনা মক্কায় অবতীর্ণ। এর আয়াতের সংখ্যা ১৩।
হাতিব ইবনে বালতায়া ছিলেন সাহাবি। তিনি বদর যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তখন মদিনায়। তিনি মক্কার কুরাইশদের দ্বারা অনুগ্রহ পাচ্ছিলেন তখনো। এদিকে রাসুল (সা.) মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হাতিব অনুগ্রহের বিনিময়ে অনুগ্রহ করতে মক্কা অভিযানের কথা কুরাইশদের জানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এটা আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর পছন্দ হয়নি। আল্লাহ সুরা মুমতাহিনার প্রথম আয়াত নাজিল করে বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না…।’ হাতিব খুব লজ্জিত হলেন। তওবা করলেন। আল্লাহ কবুল করলেন তওবা।
অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বিশ্বাসীদের আচরণনীতি, কিয়ামতের দিন কেউ কারও উপকারে না আসা, ইবরাহিম (আ.)-এর আদর্শ, বিশ্বাসী মানুষের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার, বিশ্বাসী নারী অবিশ্বাসীর জন্য হারাম এবং বিশ্বাসী পুরুষের জন্য অবিশ্বাসী নারী হারাম হওয়ার বিবরণ আছে এ সুরায়।
সুরা সফের বিষয়বস্তু
মদিনায় অবতীর্ণ সুরা সফের আয়াতের সংখ্যা ১৪। এ সুরায় আল্লাহর বড়ত্ব ও মহিমা, কথা ও কাজে মিল রাখার প্রতি নির্দেশ, যুদ্ধ ও হত্যা, আল্লাহর জন্য জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ, ইসলামের সাহায্যকারী হওয়ার আদেশ এবং ঈসা (আ.)-এর সঙ্গীদের আলোচনা রয়েছে।
আজান হলে জুমার নামাজে
সুরা জুমা মদিনায় অবতীর্ণ। এতে আয়াত আছে ১১টি। এ সুরার ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ মানুষকে জুমার নামাজের আজান হলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু ছেড়ে মসজিদে যাওয়ার আদেশ দিয়েছেন। বলেছেন মসজিদে যাওয়াতে আছে কল্যাণ। অন্য কিছুতে কল্যাণ নেই।
যারা মনে করে, অন্য কাজ করাতে উপকার আছে; আল্লাহর ভাষা তারা বোঝে না। আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে জামাতে পড়ার তাগিদ দিয়েছেন। তবে আজান হলে মসজিদে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন শুধু জুমার নামাজের ক্ষেত্রে। ইসলামে সপ্তাহের সেরা দিন শুক্রবার। এটি মুসলমানদের সমাবেশের দিন। আমলের দিন। দোয়া কবুলের সময়।
সুরা মুনাফিকুন, তাগাবুন ও তালাকের বিষয়
উল্লিখিত তিন সুরায় কপটদের কিছু চিহ্ন, মানুষকে সম্মানিত বা অসম্মানিত করা আল্লাহর কাছে, আখিরাতের বিষয়ে বিশ্বাসীদের সতর্কবার্তা, আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর পথে খরচ করা, কৃতজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞ মানুষের বয়ান, আগের জাতির পরিণাম, কিয়ামত, আল্লাহর ভয়, কৃপণতা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ, বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধান, স্ত্রীর ভরণপোষণ, তাকওয়া, আল্লাহর কুদরত ও মাহাত্ম্য ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে।
আল্লাহর প্রতিবেশী হতে চাওয়া নারীর গল্প
প্রাচীন মিসরের ফেরাউনের স্ত্রী ছিলেন আসিয়া বিনতে মুজাহিম। আসিয়া আল্লাহ–বিশ্বাসী ছিলেন। মানুষের কল্যাণে কাজ করতেন। তাঁর স্বামী ফেরাউন ছিল খোদা দাবিদার। সে বাদশাহ হিসেবে ছিল অত্যাচারী ও বদমেজাজি।
ফেরাউন একবার জানতে পারলেন, তাঁর স্ত্রী অন্যের উপাসনা করে। স্ত্রী খুব করে বোঝালেন। কাজ হলো না। ফেরাউন চটে গিয়ে তাঁকে হত্যার আদেশ দিলেন। ফেরাউনের সৈন্যসামন্ত তাঁর হাত-পা বেঁধে উত্তপ্ত সূর্যের নিচে ফেলে রাখল। ক্ষতবিক্ষত হলো তাঁর শরীর। কিন্তু তিনি ইমান ছাড়লেন না। দুনিয়ার রাজপ্রাসাদের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে চাইলেন, জান্নাতে তাঁর পাশে একটি ঘর।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমার জন্য আপনার কাছে জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করুন। আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন…।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ১১)
আবু আশফাক মুহাম্মাদ: লেখক ও আলেম