আজ খতমে তারাবিহতে পবিত্র কোরআনের সুরা ইয়াসিনের ২২ থেকে সুরা সাফফাত, সুরা সোয়াদ, সুরা জুমারের ১ থেকে ৩১ নম্বর আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করা হবে। ২৩তম পারা পড়া হবে। তারাবিহর এই অংশে নবীদের প্রতি অবিশ্বাসীদের উপহাস, আল্লাহর অস্তিত্ব, হাবিব নাজ্জারের উপদেশ, কিয়ামতের ভয়াবহতা, আল্লাহর জন্য ইবাদত, জাহান্নামিদের পরস্পরকে দোষারোপ, অবিশ্বাসীদের পরিণতি, মায়ের উদরে মানুষের অবস্থান, ইসলামি আকিদা-বিশ্বাস, শিঙায় ফুঁক, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, ফেরেশতাদের ইবাদত, পুনরুত্থান, হিসাব-নিকাশ, কোরআনের অলৌকিকতা, মুশরিকদের আপত্তির জবাব, আদম (আ.) ও শয়তানের কাহিনি ইত্যাদি বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে।
কাঠমিস্ত্রি হাবিব নাজ্জারের গল্প
আল্লাহ বলেন, ‘তাকে বলা হলো, তুমি জান্নাতে প্রবেশ কোরো।’ সে বলল, ‘হায়! আমার জাতি যদি জানতে পারত যে আমার রব আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন!’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত: ২৬-২৭)
পৃথিবীতে ইসা (আ.) আগমনের আগের ঘটনা। সেই যুগে সমৃদ্ধি ও স্থাপত্যে প্রসিদ্ধ এক নগরী ছিল তৎকালীন আন্তাকিয়া শহর (বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত)। আন্তাকিয়ার লোকেরা মূর্তিপূজা ও অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত ছিল। বহু উপাসনায় বিশ্বাসী ছিল। তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তাআলা তিনজন রাসুল পাঠান। তারা হলেন শামউন, ইউহান্না ও বাবুলস।
ওই শহরের এক প্রান্তে হাবিব ইবনে ইসমাইল নামে এক কঠিমিস্ত্রি থাকতেন। ইতিহাস তাঁকে চেনে হাবিব নাজ্জার নামে। তাঁর ছিল কুষ্ঠরোগ। এই রোগের বহু চিকিৎসা করেছেন তিনি। উপাসকদের কাছে মনপ্রাণ উজাড় করে প্রার্থনা করেছেন। কাজ হয়নি। তিনি হতাশায় পড়ে গেলেন। রাসুলদের সঙ্গে একদিন তাঁর দেখা হয়। তাঁরা তাঁকে আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। তিনি তাঁদের কাছে রাসুল হওয়ার প্রমাণ চান। তাঁরা প্রমাণ দেখাতে পারবেন জানালেন। তিনি কুষ্ঠরোগের কথা বললেন। তাঁরা বললেন, আমরা আমাদের উপাসকের কাছে প্রার্থনা করব। তিনি ভালো করে দেবেন। হাবিব বেশ আশ্চর্য হলেন তাঁদের কথায়। এত দিন এত ওষুধ আর উপসনা করেও কাজ হয়নি, তাঁরা বলছেন, তাঁদের উপাসক পারবেন। তিনি ঈমান আনেন। একদিন সুস্থ হয়ে উঠেন। তিনি নির্জনে নগরীর এক প্রান্তে আল্লাহর ইবাদত করতে থাকেন।
আন্তাকিয়বাসী রাসুলদের দাওয়াত গ্রহণ করেনি; বরং তাঁদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে থাকল। তাঁরা দাওয়াত দিতে থাকেন। একপর্যায়ে কাফেররা রাসুলদের হত্যার নীলনকশা করছে, এ খবর পায় হাবিব নাজ্জার। তিনি দ্রুত শহরে এসে তাদের সতর্ক করতে ও বোঝাতে থাকলেও কাজ হয় না। কাফেররা তাঁকে হত্যা করে। আল্লাহ তাঁকে পুরস্কার হিসেবে দেন জান্নাত। সুরা ইয়াসিনের ১৯ থেকে ২৭ নম্বর আয়াতে এই কাহিনির বিবরণ রয়েছে।
সূর্য আরশের নিচে পৌঁছে সেজদা করে
সুরা ইয়াসিনের ৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ।’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত কাতাদা বলেন, ‘সূর্য তার কক্ষ পথে মজবুত ও অটল ব্যবস্থাধীনে ভ্রমণ করছে। এতে কখনো এক মিনিট ও এক সেকেন্ডের পার্থক্য হয় না। সূর্যের এই গতি চিরস্থায়ী নয়। তার একটি বিশেষ অবস্থান আছে; যেখানে পৌঁছে তার গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে। সেটা হচ্ছে কিয়ামতের দিন।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
হাদিসে আছে, ‘আবু জার গিফারি (রা.) একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সূর্যাস্তের সময় মসজিদে উপস্থিত ছিলেন। নবীজি বললেন, আবু জার, সূর্য কোথায় অস্ত যায়, জানো? আবু জার বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সূর্য চলতে চলতে আরশের নিচে পৌঁছে সিজদা করে।’ (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, পৃ. ১,১৩৩)
সুরা সাফফাতের বিষয়বস্তু
১৮২ আয়াতবিশিষ্ট সুরা সাফফাত মক্কায় অবতীর্ণ। এটি কোরআনের ৩৭তম সুরা। সাফ অর্থ কোনো জনসমষ্টিকে এক সরলরেখায় সন্নিবেশিত করা। এ সুরার ১৬৫ নম্বর আয়াতে ফেরেশতাদের সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বর্ণনা রয়েছে, তাই এর নাম রাখা হয়েছে সুরা সাফফাত। এ সুরায় ফেরেশতাদের ইবাদত, জিনদের লুকিয়ে লুকিয়ে ঊর্ধ্বমহলের সংবাদ শোনার চেষ্টা, জ্বলন্ত অঙ্গার দিয়ে তাদের ধাওয়া করা, পুনরুত্থান, হিসাব-নিকাশ ও প্রতিদান, আল্লাহর সৃষ্টির বিবরণ, মুশরিকদের অস্বীকার, জাহান্নামিদের একে অপরকে দোষারোপ, জান্নাতিদের কথোপকথন, নুহ, ইবরাহিম, মুসা, হারুন, ইলিয়াস, লুত ও ইউনুস (আ.)-এর কাহিনির বয়ান রয়েছে।
সুরা সোয়াদে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের গল্প
কোরআনের ৩৮তম সুরা সোয়াদ মক্কায় অবতীর্ণ। এর আয়াত সংখ্যা ৮৮। এ সুরায় কোরআনের মুজেজা, আল্লাহর একাত্ববাদ, ঈমানের মূল ভিত্তি, নবী-রাসুলদের দাওয়াতের পদ্ধতি, পরকাল, অবিশ্বাসীদের অহংকার, সৎকাজের বিরোধিতা, আগের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিণতির বয়ান, দাউদ, সোলাইমান, আইয়ুব, ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, ইসমাইল, ইয়াসা ও জুলকিফল (আ.)-এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে।
ধৈর্যের পুরস্কার পেয়েছিলেন আইয়ুব (আ.)
সুরা সোয়াদের ৪১ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে আইয়ুব (আ.)-এর রোগ, তাঁর ধন-সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, সব কিছুতে তাঁর ধৈর্যধারণ এবং পরে আল্লাহর পুরস্কারের বর্ণনা রয়েছে।
আইয়ুব (আ.) ছিলেন ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধর। তাঁর ছিল প্রচুর ধন-সম্পদ। বাগান, ফলফলাদি ও ফসলি জমির কমতি ছিল না। আল্লাহর অনুগ্রহে ভরপুর ছিল তাঁর জীবন। একবার আল্লাহ তাঁর পরীক্ষা নিতে চাইলেন। আল্লাহ তাঁকে দুরারোগ্য এক রোগ দিলেন। তাঁর সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল। হারিয়ে গেল সন্তান-সন্ততি। তিনি তখন একা। তাঁর পাশে কেউ নেই। আছেন শুধু তাঁর একজন পুণ্যবতী স্ত্রী। তিনি সারাক্ষণ স্বামীর সেবা করতেন। শেষে নিজেদের খরচ মেটাতে অন্যের বাসায় কাজ করতেন। আইয়ুব (আ.)-এর রোগ, অভাব ও কষ্ট বাড়তে থাকে। এভাবে মাস পেরিয়ে বছর যায়, বছরের পর বছর। কোনো কোনো তাফসিরবিদ বলেন, এভাবে ১৮ বছর কেটেছিল। তিনি পড়ে থাকেন সম্পদহীন, সন্তানহীন, সঙ্গীহীন, আত্মীয়হীন; আছেন শুধু এক স্ত্রী। কিন্তু তিনি প্রতি মুহূর্তে ডাকতে থাকেন আল্লাহকে। প্রার্থনা করতে থাকেন। প্রার্থনায় আছে সর্বোচ্চ আদব ও নিষ্ঠা। অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই; শুধু মধুময় আবেদন। আল্লাহ তাঁর ধৈর্য ও ডাকে খুশি হলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন। দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিলেন। পরিবার-পরিজন দিলেন। দিলেন আগের চেয়ে বেশি নেয়ামত ও রহমত।
সুরা জুমারের বিষয়বস্তু
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা জুমারের আয়াতের সংখ্যা ৭৫। এটি কোরআনের ৩৯তম সুরা। আজকের তারাবিহতে এ সুরার প্রথম ৩১টি আয়াত পড়া হবে। এখানে আল্লাহর একাত্ববাদ, রাসুল (সা.)-এর মুজেজা কোরআন, লোক দেখানো ইবাদত নিষেধ, আল্লাহর একাত্ববাদের দলিল, মানুষের সৃষ্টির পর্যায়ক্রম, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের উদাহরণ ইত্যাদির বয়ান আছে।
আবু আশফাক মুহাম্মাদ: লেখক ও আলেম