যে জুব্বা পরে তিনি যুদ্ধে অংশ নেন সেটি দিয়েই তাঁকে দাফন করা হয়
ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ছিল বদরের যুদ্ধ। হজরত সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.) এবং তাঁর ভাই উমাইর (রা.) সে যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। যুদ্ধে উমাইর (রা.) শাহাদাতবরণ করেছিলেন।
বদরের যুদ্ধের এক বছর পর উহুদের যুদ্ধেও সাদ (রা.) অংশ দেন। তিনি ছিলেন দক্ষ তিরন্দাজ। সাদ (রা.) বলেন, উহুদের রণাঙ্গনে রাসুল (সা.) সব তির আমার সামনে রেখে দিয়ে বললেন, ‘আমার মা-বাবা তোমার প্রতি উৎসর্গ হোক, তুমি যথাসাধ্য তির ছুড়তে থাকো।’ (বুখারি)
উহুদের যুদ্ধের একপর্যায়ে মুসলিম বাহিনী যখন চরম বিপর্যয়ের সামনে, তখন মুষ্টিমেয় কিছু সেনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাসুল (সা.)–কে ঘিরে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে। সাদ (রা.) সেখানে ছিলেন। উহুদের যুদ্ধে সাদ (রা.) শত্রুপক্ষের প্রবল আক্রমণ থেকে রাসুল (সা.)-কে হেফাজতের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে লড়েছিলেন।
দশম হিজরিতে বিদায় হজের কিছুদিন আগে সাদ (রা.), খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাসুল (সা.) প্রায়ই তাঁকে দেখতে যেতেন। হজরত সাদ (রা.) বলেন, ‘একদিন রাসুল (সা.) আমার সঙ্গে কথা বলার পর আমার কপালে হাত রাখলেন। তারপর মুখমণ্ডলের ওপর হাতের স্পর্শ বুলিয়ে পেট পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ আপনি সাদকে শিফা দান করুন।’ রাসুল (সা.)–এর ইন্তেকালের পর সাদ (রা.) এ স্মৃতি মনে করে বলতেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর হাতের সেই শীতল স্পর্শ ও প্রশান্তি আজও আমি অনুভব করি।’
হিজরতের এক বছর পর রাসুল (সা.) ৬০ জনের একটি দলকে কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সে দলে হজরত সাদ (রা.) ছিলেন। একপর্যায়ে কুরাইশদেরও একটি বিরাট দল তাঁরা দেখতে পান। কুরাইশ পক্ষের কেউ একজন হঠাৎ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলে সাদ (রা.) সঙ্গে সঙ্গে তির নিক্ষেপ করেন। আর এটিই ছিল শত্রুপক্ষের প্রতি তাঁর প্রথম ছুড়ে দেওয়া তির।
নবুয়তের তৃতীয় বছরে নতুন ইসলাম গ্রহণকারী আমর ইবনে আবাসা শিয়াবে আবি তালিবের এক কোণে নামাজ আদায় করছিলেন। হঠাৎ কুরাইশরা এসে তাঁকে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। তা দেখে সাদ (রা.) এগিয়ে তাদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হন। একপর্যায়ে তিনি চাবুক দিয়ে আঘাত করলে তাদের একজনের আহত হয়।
সাদ (রা.) সম্পদশালী ছিলেন। কিন্তু সম্পদ তাঁকে অহংকারী না করে দানশীল করেছিল।
হজরত উসমান (রা.)–এর হত্যাকাণ্ডের পর ইসলামের ইতিহাসে এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সূচনা হয়। সে সময় মুসলিম উম্মাহ তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল হজরত আলীর পক্ষে, একদল হজরত আলীর বিপক্ষে এবং একদল নিরপেক্ষ। হজরত সাদ (রা.) ছিলেন নিরপেক্ষ দলে। তিনি উট বা সিফফিনের যুদ্ধে কোনো পক্ষে যোগ না দিয়ে মদিনায় নিজের বাসায় ছিলেন। উসমান (রা.)–এর শাহাদাতের পর এভাবেই তিনি নির্জনতা অবলম্বন করেন। একবার উটের আস্তাবলে তাঁকে দেখে তাঁর ছেলে উমার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি উট ও ছাগলের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন আর এদিকে লোকেরা রাষ্ট্রীয় ঝগড়ায় লিপ্ত।’ হজরত সাদ ছেলের বুকের ওপর হাত রেখে বললেন, ‘আমি রাসুলকে (সা.) বলতে শুনেছি, আল্লাহ ভালোবাসেন নির্জনবাসী, মুত্তাকি এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় নিরাসক্তদের।’
হজরত সাদ (রা.) মুয়াবিয়া (রা.)–র শাসনামলে হিজরি ৫৫ সনে মদিনা থেকে ১০ মাইল দূরে আকিক উপত্যকায় মৃত্যুবরণ করেন। অধিকাংশের মতে, মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮৫ বছর। যে জুব্বাটি পরে তিনি ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সেটি দিয়েই তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘এ জুব্বাটি দিয়েই তোমরা আমাকে কাফন দেবে। এ জুব্বা পরেই আমি বদর যুদ্ধে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়েছি। এটা নিয়েই আমার আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছা।’
তাঁর মৃত্যুর পর আয়েশা (রা.) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামদের অনুরোধে তাঁর লাশ মসজিদে নববিতে আনা হয়।