নবীজি (সা.)-এর আমলে মদিনার জনসংখ্যা কত ছিল
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই হিজরতের মধ্য দিয়ে তিনি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে ইয়াসরিব শহরে যান। নবীজির (সা.) সম্মানে নগরীটির নাম মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর রাখা হয়। এখন বলা হয় মদিনা মুনাওয়ারা বা আলোকিত শহর। মদিনার জনসংখ্যা এবং সেখানে মুসলিমদের সংখ্যা নিয়ে নানা ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে।
৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, অর্থাৎ মহানবীর শেষ সময়ে মক্কার জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩০ হাজার। মক্কা তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। জনসংখ্যা প্রধান অংশ ব্যবসায়ী, কারিগর ও কুরাইশ গোত্রের লোকজন। মক্কার মোট এলাকা ছিল তখন বারো শ বর্গকিলোমিটার। এক বর্গকিলোমিটারে হাজারখানেক মানুষ বাস করতে পারে, কিন্তু মরুভূমি অঞ্চলে খাদ্য ও পানির কম প্রাপ্যতার কারণে এ সংখ্যা কম হওয়াই যুক্তিসংগত। মরু অঞ্চলে ১ বর্গ কিলোমিটারে একশ জন মানুষ বাস করতে পারে। সে হিসাবে অনুমান করা যায় ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা সম্ভবত ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজারের মাঝামাঝি জনসংখ্যার ঠাঁই ছিল।
মদিনার জনসংখ্যা
ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন, তখন মদিনার জনসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার থেকে ১ লাখের মধ্যে। ইবনে হিশামের মতে, মদিনার জনসংখ্যাটা প্রায় ১০,০০০। (সিরাহ আন-নাবাবিয়্যা, ২/১৭৮)। আল-ওয়াকিদি মনে করেন, প্রায় ৫০ হাজার। (মাগাজি রাসুলুল্লাহ, ১/২৪৮)। ইবন সাদের মত হলো, এ সংখ্যা ৩০ হাজারের কম নয়। (আল তাবাকাত আল কুবরা, ১/৪২২)
ওপরের তথ্যগুলো নিশ্চয় মহানবীর শেষ সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়। কেননা, মক্কা বিজয়ের সময় মুসলিম বাহিনী হিজরি ৮ সালের ১০ রমজান (৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে) মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথে বিভিন্ন মিত্র গোত্রের স্বেচ্ছাসেবক এবং দল মুসলমানদের দলে যোগ দেয়। তাতে কাফেলার আকার প্রায় ১০ হাজারে পৌঁছে যায়। এ তথ্যে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দ্বিমত কম।
মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ অনুমান করেনম ৬২০ সালের আশপাশে মদিনার বিভিন্ন শহরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ বাস করত। এই অনুমান অনেকটাই যুক্তিসংগত। কারণ সে সময় মদিনা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। (লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ মুহাম্মদ, মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ, পৃ ১৭০)।
মানুষের বিন্যাস
মুহাজির: মক্কা থেকে মদিনায় মুসলমানদের প্রথম হিজরতের সময় আনুমানিক ৮০ জন পুরুষ এবং ৩৫ জন নারী মক্কা থেকে হিজরত করেছিলেন। আনুমানিক ৩৫ জন শিশুকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা যায়। বলা চলে, মোট ১৫০ জন মুহাজির বা অভিবাসী মদিনায় এসেছেন। (সিরাত রাসুলুল্লাহ, ইবনে ইসহাক, পৃ ২১৮)।
আনসার: আনসারদের মধ্যে আওস ও খাজরাজ দুইটি প্রধান উপজাতি ইসলামে দীক্ষা নেয়। এ দুই গোত্র মিলে দুই হাজারের মতো যোদ্ধা ছিল বলে অনুমান করা হয়। (আল তাবাকাত আল কুবরা, ইবনে সাদ, ২/৬৯)। সে হিসাবে ধারণা করা যায়, আওসের আনুমানিক এগারো শ পুরুষ, এগারো শ ২৫ জন নারী এবং এক হাজার শিশু ছিল । খাজরাজের আনুমানিক ৬০০ পুরুষ, ৬২৫ নারী ও ৫৫০ শিশু ছিল।
ইহুদি: মদিনায় ছিল ইহুদিদের তিনটি প্রধান গোত্র—কাইনুকা, নাজির ও কুরাইজা। ইহুদি গোত্রগুলোর যোদ্ধাদের সংখ্যা থেকে তাদের জনসংখ্যার অনুমান করা যেতে পারে। আমরা জানি, কাইনুকার আনুমানিক সাত শ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ছিল। আর বানো কুরাইজা গোত্রে ছয় শ থেকে নয় শ যোদ্ধা ছিল। সংখ্যাটা আমরা আট শ ধরে নিতে পারি (সিরাত রাসুলুল্লাহ, ইবনে ইসহাক, পৃ ৩৬৩, ৪৬৪)।
সবচেয়ে ছোট ইহুদি গোত্র ছিল সম্ভবত কাইনুকা। এর একটি যুক্তি হতে পারে যে তারা বড় খাজরাজ গোত্রের সঙ্গে মিত্রতা রেখেছিল; অথচ নাজির ও কুরাইজার মিত্র ছোট আওস গোত্র। (মুহাম্মদ অ্যাট মদিনা, মন্টোগোমারি ওয়াট, পৃ ১৫৭ ও ১৯৫)। এ যুক্তির কারণ হলো, মহানবীর আগমনের আগে মদিনায় গৃহযুদ্ধের সময় কোনো পরিষ্কার বিজয়ী গোষ্ঠী ছিল না, যদিও কিছু সূত্র আওসের বিজয় নির্দেশ করে। মিত্রদের বিন্যাস উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সুষম ভারসাম্য সৃষ্টি করেছিল।
এ সংখ্যাগুলো মাথায় রেখে এবং নারীদের ও শিশুদের জন্য অনুমান যুক্ত করে মদিনার তাদের জনসংখ্যার একটি তালিকাটি হয় এমন—কাইনুকার প্রায় ছয় শ পুরুষ, ছয় শ ২৫ জন নারী ও ছয় শ ৫০ শিশু। নাজিরের প্রায় সাত শ পুরুষ, সাত শ ২৫ নারী ও সাত শ ৫০ শিশু ছিল। কুরাইজার প্রায় সাত শ পুরুষ, আট শ ২৫ নারী ও নয় শ শিশু ছিল।
এটি অবশ্যই একটি অনুমান–নির্ভর সংখ্যা। এই পরিসংখ্যান হামিদুল্লাহের অনুমান এবং অন্যান্য দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে দেখা যায়, সে সময় ইহুদি জনসংখ্যা ছিল নগরীর প্রায় অর্ধেক।
এই পরিসংখ্যান মদিনায় মহানবীর (সা.) প্রথম মাসগুলোতে কর্মতৎপরতার প্রভাব ও গতি বুঝতে সহায়তা করে। অর্থাৎ, মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় পৌঁছেই শহরটাকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন তেমন নয়, বরং মুসলমানদের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অংশটি ছিল মোট জনসংখ্যার একটি ছোট অংশ। প্রথম অবস্থায় নিবেদিত মুসলিমদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি ছিল না। ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল ৩১৩। এ থেকেও তা ধারণা করা যায়। অথচ আনসারদের সংখ্যা ছিল ২৩১ (সীরাত রাসুলুল্লাহ, ইবনে ইসহাক, পৃ ৩৩৬)।
সে সময় মদিনার মুসলমানদের সংখ্যা গণনা করা হয়েছিল মোট দেড় হাজার জন। এটি ছিল মোট আনুমানিক জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ। এই পরিসংখ্যার কখন নেওয়া হয়েছিল তার কোনো বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়নি, কিন্তু হাদিসের বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমরা কি (কাফিরদের) ভয় পাব যদিও আমরা এক হাজার পাঁচ শ জন?’ (বুখারি, হাদিস: ৩০৬০)।
মদিনার জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও হ্রাসে বিভিন্ন মৌসুমি পরিবর্তন, ব্যবসায়ীদের আগমন ও প্রস্থান এবং হিজরতের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। মুসলমানদের হিজরতের ফলে মদিনার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবে কিছু লোক মদিনা ত্যাগ করায় জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল।
মদিনার সঠিক জনসংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ, ওই সময়ে জনসংখ্যা গণনার কোনো আধুনিক পদ্ধতি ছিল না। তবু নানা তথ্য থেকে আমো একটি সাধারণ ধারণা পেতে পারি।