রাসুলে করিম (সা.) সম্পর্কে উতবার উক্তি
মুহাম্মদ ইবনে কাব আল-কুরাজির সূত্রে ইয়াসিদ ইবনে জিয়াদ আমাকে বলেছেন, কোরাইশদের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উতবা ইবনে রাবিয়া একদিন কোরাইশদের সঙ্গে জামাতে বসা ছিলেন। কাবা প্রাঙ্গণে এক জায়গায় একা বসা ছিলেন নবী করিম (সা.)। উতবা ইবনে রাবিয়া তখন বললেন, ‘মুহাম্মদের কাছে যদি আমি যাই, তাঁর কাছে কিছু প্রস্তাব দিই এবং তার কিছু কিছু যদি সে মেনে নেয়, আমাদের কাছে যা চায় তাই যদি দিয়ে দিই আর বিনিময়ে সে আমাদের শান্তিতে থাকতে দেয়, তাহলে কেমন হয়?’
এটি হামজার ইসলাম গ্রহণের পরের ঘটনা। রাসুলের অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের দল ভারী হচ্ছে। এটি কোরাইশরা লক্ষ করছে নিঃশব্দে। উতবার প্রস্তাব সবার খুব পছন্দ হলো। উতবা তখন রাসুলে করিমের (সা.) কাছে গিয়ে বসলেন। বললেন, ‘বৎস, তুমি তো আমাদেরই লোক। কত উচ্চ বংশে তোমার জন্ম তুমি তো জানোই, কত পুরোনো খান্দানি ঘর তোমাদের। তুমি তোমার জাতির কাছে এসেছ এক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে। সে জিনিস দিয়ে তুমি তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছ, তাদের জীবনধারাকে উপহাস করছ, বলছ তাদের পূর্বপুরুষ সব অবিশ্বাসী। আমার কথা শোনো, আমার কতগুলো প্রস্তাব আছে। এর একটা না একটা তোমার কাছে হয়তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে।’
রাসুলে করিম (সা.) তাকে প্রস্তাবগুলো দেওয়ার জন্য সম্মতি দিলেন।
উতবা বললেন, ‘তুমি যদি টাকা চাও আমরা সবাই আমাদের সম্পত্তি তোমাকে দিয়ে দেব, তুমি হবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী মানুষ। তুমি যদি ইজ্জত চাও, আমরা তোমাকে আমাদের সর্দার বানাব, কেউ তোমার কথা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তুমি যদি রাজ্য চাও, আমরা তোমাকে রাজা বানাব। আর যে ভূত তোমার কাঁধে ভর করে তাকে তুমি যদি দূর করতে না পারো, তাহলে আমরা ওঝা ডাকব, আমরা সর্বস্ব দিয়ে হলেও তোমাকে সুস্থ করে তুলব, কারণ যার ওপর ভূতের আসর হয়, সে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ভূত তাকে ছাড়ে না।’
হয়তো এই ভাষায় নয়, কিন্তু কথা ছিল এই ধরনের।
রাসুলে করিম (সা.) ধৈর্য সহকারে শুনে গেলেন। পরে বললেন, ‘এখন আপনি আমার কথা শুনুন, দয়াময় পরম দয়াবান আল্লাহ্র নামে, হামিম, আমি যা বলছি তা দয়াময়, পরম করুণাময়ের কাছ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা আরবি কোরআনরূপে অবতীর্ণ হয়েছে, এর সমস্ত আয়াত জ্ঞানী মানুষের জন্য বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে, সুসংবাদের মতো, সতর্কবাণীর মতো, কিন্তু তাদের অনেকেই মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, তারা কিছুই শুনবে না, তারা বলে, তুমি যার প্রতি আমাদের আহ্বান করছ তার প্রতি আমাদের অন্তর আবরণ-আচ্ছাদিত।’
রাসুলে করিম (সা.) তারপর আরও আবৃত্তি করে শোনালেন উতবাকে।
উতবা গভীর মনোযোগে শুনে গেলেন, তাঁর দুই হাত পেছন দিকে, সেই তাঁর দেহের ভর। সেজদার জায়গায় এসে রাসুলে করিম (সা.) বক্তব্য শেষ করলেন, সেজদা দিলেন। তারপর বললেন, ‘যা শোনার তা আপনি শুনলেন আবুল ওয়ালিদ। এখন কী করবেন করুন।’
উতবা আপন সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেলেন, সঙ্গীরা দেখল, তার মুখভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। তারা আলোচনার ফলাফল জানতে চাইল। তিনি বললেন, তিনি এমন কথা শুনে এসেছেন, যা জীবনে কোনো দিন শোনেননি। যা শুনেছেন তা কবিতা নয়, জাদু নয়, মন্ত্র নয়। বললেন, ‘আমার কথা শোনো, আমি যা করি তা-ই তোমরা করো। ওর পেছনে তোমরা লেগো না। আল্লাহ্র কসম, যে কথা আমি শুনে এলাম তা জ্বলবে চারদিকে। যদি অন্য আরবরা তাকে হত্যা করে, তারা তোমাদেরও ছাড়বে না। ও যদি আরবদের ভালো করতে পারে, ওর আধিপত্য হবে তোমাদের সার্বভৌমত্ব, তার ক্ষমতা হবে তোমাদের ক্ষমতা, ওকে দিয়ে তোমরা সমৃদ্ধ হবে, সুখের মুখ দেখবে।’
ওরা বলল, ‘কথা দিয়ে ও আপনাকে জাদু করে ফেলেছে।’
তিনি বললেন, ‘আমার কথা তোমরা শুনলে। এখন তোমরা যা ভালো মনে করো, করো।’
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে