একজন ব্যবসায়ী সাহাবির গল্প
রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ছিলেন হাতেগোনা সেসব সাহাবিদের একজন, যাঁরা দুনিয়ায় থাকতে জান্নাতের সুসংবাদ পান। তিনি ছিলেন ‘আশারায়ে মুবাশশারা’ বা সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের একজন।
মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় তিনি ছিলেন প্রায় রিক্তহস্ত। হাতে ছিল মাত্র দুই বা চার দিনার।
মদিনায় গেলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন করে দেন সাদ ইবনে রাবিআ (রা.)–র সঙ্গে। সা’দ ইবনে রাবি’আ ছিলেন মদিনার অন্যতম ধনী সাহাবি। তাঁর অনেক জমিজমা ছিল, একাধিক স্ত্রী ছিলেন।
সাহাবিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন করা হলে একেকজন সাহাবি তাঁর ভাইকে সবকিছু উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা চাইতেন নিজেরা যতটা ভালো আছেন, অপর ভাইকেও ততটা ভালো রাখতেন। নিজেরা যতটা সম্পদশালী আছেন, অপর ভাইকেও ততটা সম্পদশালী বানাতেন।
সা’দ ইবনে রাবিআ (রা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-কে বলেন, ‘ভাই আমার। সবাই জানে যে আমি আনসারদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তোমার সঙ্গে আমার ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক হয়েছে। তুমি কী চাও আমার কাছে? তুমি আমার কাছে যা চাইবে, আমি তোমাকে তাই দেব।’
মদিনার ধনকুবের সা’দ ইবনে রাবিআ (রা.) তাঁর দ্বীনি ভাই আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-কে নিজের অর্ধেক সম্পত্তি দিতে চাইলেন। কিন্তু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আবদুর রহমান ইবনে আউফ বিনয়ের সঙ্গে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ আপনার সম্পদে বরকত দিন। আমাকে শুধু বাজারের পথটি দেখিয়ে দিন।’
সাদ ইবনে রাবিআ (রা.) বাজারের পথটি দেখিয়ে দিলে আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) চলে গেলেন মদিনার বাজারে। মদিনার বাজারে তিনি আগন্তুক। প্রথমে বাজার পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর সঙ্গে থাকা অতি অল্প দিনার দিয়ে কিসের ব্যবসা করা যায়। সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন ঘি ও পনিরের ব্যবসা করবেন।
আবদুর রহমান ইবনে আউফের সুযোগ ছিল তাঁর ধনকুবের বন্ধুর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার। কিন্তু শুরুতেই ঋণ না নিয়ে নিজের যা আছে তাই দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এই ব্যবসায়ে নগদ প্রবাহ ছিল দ্রুত।
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবসায় মুনাফা লাভ করলেন। তখন তিনি বিয়েও করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে একটি বকরি দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করতে বলেন।
নতুন শহরে শুরু হলো আবদুর রহমান ইবনে আউফের ব্যবসা–জীবন। ঘি আর পনিরের ব্যবসা করার পর আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ঘোড়ার জিনের ব্যবসা করেন।
এই ব্যবসা ছিল বেশ লাভজনক। এটা অনেকটা গাড়ি বিক্রি না করে গাড়ির বিভিন্ন পার্টস বিক্রি করার মতো।
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) এই ব্যবসায় সফল হওয়ার পর ঘোড়া কেনা শুরু করেন। তিনি ঘোড়ার ব্যবসা শুরু করেন।
তাঁর ব্যবসার অন্যতম সফলতা ছিল, তিনি দ্রুত বিক্রি করতেন। অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুত করতেন না।
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) -এর ব্যবসায় সফলতার আরেক কারণ ছিল তাঁর দান-সাদকা। তিনি প্রচুর দান করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দান করলে সম্পদ কমে না; বরং বাড়ে।’
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ব্যবসায় প্রাপ্ত মুনাফার বিপুল অংশ দান করতেন। এমনকি কখনো কখনো তাঁর ব্যবসার মূলধন থেকেও দান করতেন।
একবার মদিনায় ৭০০ উট বোঝাই পণ্য আসে। মদিনায় এর আগে এত বিশাল পরিমাণ পণ্য আসেনি। সবাই অবাক হলো। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) চাইলে একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ৭০০ উট বোঝাই পণ্য মানুষের মধ্যে দান করে দেন। একেকটি উটে ১০ হাজার টাকার পণ্য থাকলে তিনি এক দিনেই দান করেন প্রায় ৭০ লাখ টাকা!
আরেকবার আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) উসমান (রা.)-এর কাছে একটি জমি বিক্রি করেন ৪০,০০০ দিনার দিয়ে। ৪০,০০০ দিনার দিয়ে সাহাবিদের সময় চল্লিশ হাজার ভেড়া কেনা যেতো। দুই ধনী সাহাবির মধ্যে লেনদেন। এক ধনী সাহাবি জমি বিক্রি করেন, আরেক ধনী সাহাবির কাছে।
একটি ভেড়ার দাম বর্তমানে ১০,০০০ টাকা হলে ৪০ হাজার ভেড়ার দাম হবে ৪০ কোটি টাকা!
জমি বিক্রির টাকা তিনি তিন ভাগে ভাগ করেন।
১. একভাগ দেন তার নিকটাত্মীয় বনু নাজিরকে।
২. একভাগ দেন মদিনার দরিদ্র লোকদের।
৩. আরেক ভাগ দেন উম্মুল মুমিনীনদের।
মাত্র দু–চার দিনার নিয়ে হিজরত করেছিলেন আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)। মদিনায় হিজরতের প্রায় ৩০ বছর জীবিত ছিলেন তিনি। এই ৩০ বছরে ব্যবসা করে আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) আজকের বাজার মূল্যে কয়েক শ কোটি টাকা উপার্জন করেন!
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) যখন ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল এ রকম: ১০০টি উট, ৩০০০ ভেড়া, ১০০ ঘোড়া জমিতে পানি দেওয়ার জন্য ২০টি উট এবং ১৯ লক্ষ ২০ হাজার দিরহাম রেখে যান; যা দিয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার ভেড়া কেনা যেত। ১০,০০০ টাকা ভেড়ার মূল্য ধরলে তাঁর রেখে যাওয়া নগদ অর্থের মূল্য দাঁড়ায় ১৬০ কোটি টাকা।
এত সম্পদ উপার্জন করতে গিয়ে আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) নামাজ-রোজা তো ছেড়ে দেনইনি, বরং এর পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে প্রায় সব যুদ্ধে অংশ নেন। কোটি টাকার সম্পদ তাঁকে প্রতারিত করতে পারেনি। যখনই কেউ তাঁর কাছে সহযোগিতা চাইতেন, তিনি সহযোগিতা করতেন। এ কারণে দুনিয়াতে থাকতে তিনি জান্নাতের সুসংবাদ পান।