সুরা কাহাফে গুহাবাসীর আখ্যান
পবিত্র কোরআনের ১৮ তম সুরা আল কাহাফ। কাহাফ মানে গুহা। এ সুরার আয়াত সংখ্যা ১১০। মক্কায় অবতীর্ণ এই সুরায়, গুহাবাসীদের বিবরণ স্থান পেয়েছে। সরল পথের আলোচনা করে মোহাম্মদ (সা.)-কে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে, মক্কাবাসীদের পথদ্রষ্টতার জন্য চিন্তা করা নিরর্থক, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। জ্ঞানান্বেষণে এক আল্লাহ ভক্ত মহাপুরুষের সাক্ষাৎ এবং জুল কারনাইন ও ইয়াজুজ মাজুজের বিবরণ রয়েছে।
সুরা কাহাফে চারটি ঘটনা, চারটি বক্তব্য ও উপদেশ রয়েছে। সুরার ১ থেকে ৮ আয়াতে রয়েছে বক্তব্য। কোরআনে আছে, ‘প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর দাসের প্রতি এ-কিতাব অবর্তীর্ণ করেছেন ও এর মধ্যে তিনি কোনো অসংগতি রাখেননি। তাঁর কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য একে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, আর বিশ্বাসীগণ যারা সৎকাজ করে তাদেরকে সুসংবাদ দেবার জন্য যে তাদের জন্য বড় ভালো পুরস্কার রয়েছে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর তাদেরকে সতর্ক করার জন্য যারা বলে যে, আল্লাহ্ সন্তান গ্রহণ করেছেন, এ-বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই ও তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না। উদ্ভট কথাই তাদের মুখ থেকে বের হয়, তারা কেবল মিথ্যাই বলে। তারা এই বাণীতে বিশ্বাস না করলে তাদের পেছনে পেছনে ঘুরে ঘুরে তুমি হয়তো দুঃখে নিজেকে শেষ ক'রে ফেলবে। পৃথিবীর ওপর যা-কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার শোভা করেছি মানুষকে এই পরীক্ষা করার জন্য যে, ওদের মধ্যে কে কর্মে ভালো। তার ওপর যা-কিছু আছে তাকে আমি বিরানভূমিতে পরিণত করব।’(সুরা সুরা কাহাফ, আয়াত ১ থেকে ৮ )
গুহাবাসীর চমকপ্রদ আখ্যান
অবিশ্বাসে ভরা সমাজে কয়েকজন যুবক আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছিলেন। বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাঁরা একটি গুহায় গিয়ে লুকালেন। সেখানে আল্লাহ তাঁদের সবাইকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন।
ঘুম ভাঙার পর তাঁরা বুঝতেই পারেননি, তাঁদের ঘুমের মধ্যে আল্লাহ অনেকগুলো বছর অতিবাহিত করে ফেলেছেন। এ অবস্থায় তাঁদের একজন খাবার কিনতে শহরে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন, লোকজন তাঁকে চিনে ফেলবে এবং তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলেন, কেউ তাঁকে চেনে না। খাবার কিনে টাকা পরিশোধ করার সময় পুরোনো মুদ্রা দেখে শহরের লোকেরা হতবাক হয়ে গেল।
এ ঘটনার তাৎপর্য একাধিক। তবে আল্লাহ কীভাবে তাঁর ওপর সমর্পিত বান্দাদের কী করে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেন, তা দেখানো হয়েছে।
৯ থেকে ২৬ আয়াতে আছে আসহাবে কাহাফের ঘটনা। কোরআনে আছে, তুমি কি মনে কর না যে, গুহা ও রাকিমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনগুলোর মধ্যে আশ্চর্য বিষয়? যখন যুবকেরা গুহায় আশ্রয় নিল তখন তারা বলল, 'হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি নিজ থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান করো ও আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করো।' তারপর আমি ওদেরকে গুহায় কয়েক বছর ঘুমন্ত অবস্থায় রাখলাম। পরে আমি ওদেরকে জাগালাম এই জানবার জন্য যে দুদলের মধ্যে কোনটি ওদের অবস্থানকাল ঠিক নির্ণয় করতে পারে। আমি তোমার কাছে ওদের বৃত্তান্ত সঠিকভাবে বয়ান করছি। ওরা ছিল কয়েকজন যুবক। ওরা ওদের প্রতিপালকের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। আর আমি ওদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
আর আমি ওদের চিত্ত দৃঢ় ক'রে দিলাম, ওরা যখন উঠে দাঁড়াল তখন তারা বলল, 'আমাদের প্রতিপালক আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিপালক। আমরা কখনোই তাঁরপরিবর্তে অন্য কোনো উপাস্যকে ডাকব না; যদি করি, তবে তা খুব খারাপ হবে। আমাদের এই জাতভাইয়েরা তাঁর পরিবর্তে বহু উপাস্য গ্রহণ করেছে। এরা এসব উপাস্য সম্বন্ধে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ্ সম্বন্ধে মিথ্যা বানায় সে ছাড়া বড় সীমালঙ্ঘনকারী আর কে? তোমরা যখন ওদের থেকে ও আল্লাহ্র পরিবর্তে যাদের উপাসনা করে তাদের থেকে আলাদা হলে তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করার ব্যবস্থা করবেন।' তোমরা দেখলে দেখতে তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থান করছে। সূর্য ওঠার সময় তাদের গুহার ডানে হেলে আছে আর ডোবার সময় তাদের বাম পাশ দিয়ে পার হচ্ছে। এ-সমস্ত আল্লাহ্র নিদর্শন। আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন সে সৎপথপ্রাপ্ত, আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি কখনোই তার কোনো পথপ্রদর্শনকারী বা অভিভাবক পাবে না।তুমি মনে করতে ওরা জেগে ছিল, কিন্তু ওরা ঘুমিয়ে ছিল। আমি ওদেরকে ডানে ও বামে পাশ ফেরাতাম। আর ওদের কুকুরের সামনের দুই পা ছড়িয়ে ছিল গুহার দ্বারদেশে। ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলে তুমি পিছন ফিরে পালাতে আর ভয়ে ঘাবড়ে যেতে। আর এভাবেই আমি ওদেরকে ওঠালাম যাতে ওরা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে। ওদের একজন বলল, 'তোমরা কতকাল ধরে আছ?' কেউ-কেউ বলল, 'এক দিন বা এক দিনের কিছু অংশ।' কেউ-কেউ বলল, 'তোমরা কতকাল আছ তা তোমাদের প্রতিপালকই ভালো জানেন। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এ-টাকা দিয়ে শহরে পাঠাও, সে যেন ভালো খাবার দেখে তোমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসে। সে যেন বুদ্ধি ক'রে কাজ করে ও কিছুতেই যেন তোমাদের সম্বন্ধে কাউকে কিছু জানতে না দেয়।'
ওরা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে তবে তোমাদেরকে পাথর মেরে খুন করবে বা তোমাদেরকে ওদের ধর্মে ফেরাবে, আর তাহলে তোমরা কখনোই সফল হবে না। আর এভাবেই আমি (মানুষকে) ওদের বিষয় জানিয়ে দিলাম যাতে তারা জানতে পারে যে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি সত্য ও কিয়ামতের কোনো সন্দেহ নেই। যখন তারা তাদের কর্তব্যবিষয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক করছিল তখন অনেকে বলল, 'ওদের ওপর সৌধ নির্মাণ করো।' ওদের প্রতিপালক ওদেরবিষয় ভালো জানেন। তাদের কর্তব্যবিষয়ে যাদের মত প্রবল হলো তারা বলল, 'আমরা তো অবশ্যই ওদের ওপর মসজিদ গড়ব।' অজানা বিষয়ে অনুমানের ওপর নির্ভর করে কেউ-কেউ বলবে, 'ওরা ছিল তিনজন, ওদের কুকুর নিয়ে চারজন।' আর কেউ-কেউ বলবে, 'ওরা ছিল পাঁচজন, ওদের কুকুর নিয়ে ছয়জন। আবার কেউ-কেউ বলবে, 'ওরা ছিল সাতজন, ওদের কুকুর নিয়ে আটজন।' বলো, 'আমার প্রতিপালকই ওদের সংখ্যা ভালো জানেন। ওদের সংখ্যা অল্প কয়েকজনই জানে।' মামুলি আলোচনা ছাড়া তুমি ওদের বিষয়ে তর্ক কোরো না আর ওদের কাউকে ওদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা কোরো না।কখনোই তুমি কোনো ব্যাপারে বোলো না, 'আমি ওটা আগামীকাল করব', 'ইনশা আল্লাহ্' না বলে। যদি ভুলে যাও তবে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ কোরো ও বোলো 'সম্ভবত আমার প্রতিপালক আমাকে গুহাবাসীর কাহিনির চেয়েও নিকটতর সত্যের পথের নির্দেশ দেবেন।' ওরা ওদের গুহায় ছিল তিন শ নয় বছর। তুমি বলো, 'তারা কতকাল ছিল তা আল্লাহই ভালো জানেন। আকাশ ও পৃথিবীর অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই। তিনি কত সুন্দরভাবে দেখেন ও শোনেন। তিনি ছাড়া ওদের কোনো অভিভাবক নেই। তিনি কাউকেই নিজের কর্তৃত্বের শরিক করেন না।' (সুরা সুরা কাহাফ, আয়াত ৯ থেকে ২৬, কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন)