ইউসুফ (আ.) ছিলেন নবী ইয়াকুব (আ.)-এর প্রিয় ছেলে। তাঁর নামে কোরআনে স্বতন্ত্র একটি সুরা আছে। সেখানে তাঁর জীবনকথার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। তাঁরা ছিলেন ১২ ভাই। ইয়াকুব (আ.)-এর ১২ ছেলের মধ্যে প্রথম ১০ ছেলে প্রথম স্ত্রী লাইয়া বিনতে লাইয়ানের ঘরে জন্মলাভ করেন। তিনি মৃত্যুবরণ করলে তাঁর বোন রাহিলকে বিয়ে করেন ইয়াকুব (আ.)। তাঁর ঘরে জন্ম নেন ইউসুফ (আ.) ও বেনিয়ামিন। (তাফসিরে কুরতুবি, তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃ ৬৫৪)
ইউসুফ (আ.) ছিলেন খুবই সুদর্শন। বাবা তাঁকে অন্যদের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। কেননা ইউসুফ (আ.) শৈশবে একটি বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখেন, যা ছিল তাঁর নবী হওয়ার শুভবার্তা। এ ছাড়া ইউসুফ ছিলেন মা–হারা এতিম বালক এবং ভাইদের মধ্যে ছোট। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘ইউসুফ তার বাবাকে বলল, হে আব্বাজান, আমি (স্বপ্নে) দেখেছি ১১টি তারকা আর সূর্য ও চন্দ্র; তারা আমাকে সেজদা করছে।’ (সুরা–ইউসুফ, আয়াত: ৪)
ইউসুফের প্রতি বাবার অতিরিক্ত ভালোবাসার ব্যাপারটি অন্য ভাইয়েরা মেনে নিতে পারতেন না। তাঁরা হিংসায় জ্বলতেন। ইয়াকুব (আ.) তাঁদের মনোভাব বুঝতে পারতেন। তাই ইউসুফকে চোখে চোখে রাখতেন। একদিন তাঁরা ইউসুফকে জঙ্গলের এক কুয়ায় ফেলে দেন। বাড়ি ফিরে বাবাকে ইউসুফের মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ দেন তাঁরা। পুত্রের শোকে কাঁদতে কাঁদতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন বাবা। (সুরা–ইউসুফ, আয়াত: ১৮)
সেই কুয়ার পথ ধরে ফিরছিল একটি কাফেলা। কুয়ি থেকে বালতি ওঠাতেই ফুটফুটে সুন্দর ইউসুফকে দেখতে পায়। তারা তাঁকে মিসরে বিক্রি করে দেয়। মিসরের মন্ত্রী কিতফির তাঁকে কিনে নেন। সেখানকার প্রাসাদে তিনি বড় হতে থাকেন।
একসময় যৌবনে পা রাখেন ইউসুফ (আ.)। রূপ ও সৌন্দর্যে ভরপুর ছিল তাঁর যৌবন। চেহারা ছিল চন্দ্র ও সূর্যের মতো দীপ্তিমান। নিষ্কলুষতা ও লজ্জার আধিক্য সোনায় সোহাগার মতো কাজ করছিল তাঁর মধ্যে। মাধুর্য ও কমনীয়তার মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। (কাসাসুল কোরআন, হিফজুর রহমান, অনুবাদ: মাওলানা আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড: ৩, পৃ ১৭)
মিসরের মন্ত্রীর স্ত্রী জুলেখা। তিনি ছিলেন ইউসুফের প্রতি বরাবরই বিমোহিত। তাঁর রূপে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। নিজের মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ইউসুফকে খারাপ কাজের প্রতি আহ্বান করেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ইউসুফকে বশে আনতে নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকেন জুলেখা। জাদুও করেছিলেন একবার। তবে এতে কাজ হয়নি।
একদিন ইউসুফকে ঘরে একা পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেন জুলেখা। পাপের দিকে আহ্বান করেন তাঁকে। আল্লাহর ভয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। জুলেখার জোরাজুরিতে উপায় না পেয়ে বন্ধ দরজার দিকে দৌড় দিলেন ইউসুফ। দরজা খুলে গেল।
দরজার ওপাশে আজিজে মিসর কিতফির ও জুলেখার চাচাতো ভাই দাঁড়ানো ছিলেন। জুলেখা ইউসুফের ওপর অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সত্যতা যাচাইয়ে ছেঁড়া জামার প্রমাণ পেশ করা হলো। কিন্তু জামার পেছন দিক ছেঁড়া থাকায় জুলেখা অপরাধী সাব্যস্ত হলেন।
এ ঘটনা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে: ‘সে (ইউসুফ) বলল, সে-ই আমার থেকে অসৎ কর্ম কামনা করেছে। তখন নারীর পরিবারের এক সাক্ষী সাক্ষ্য দিল, যদি তার জামা সম্মুখ দিক থেকে ছেঁড়া হয়ে থাকে, তবে নারী সত্য বলেছে আর সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। আর যদি তার জামা পেছন থেকে ছেঁড়া হয়ে থাকে, তবে নারী মিথ্যা বলেছে আর সে সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। স্বামী যখন ইউসুফের জামাটি পেছন থেকে ছেঁড়া দেখতে পেলেন, তখন তিনি বললেন, এসব হলো তোমাদের নারীদের ছলনা, তোমাদের কূটকৌশল বড়ই কঠিন।’ (সুরা–ইউসুফ, আয়াত: ২৬-২৮)
ইউসুফ (আ.)-এর ওপর অপবাদ দিয়েছিলেন জুলেখা। একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু ইউসুফ (আ.)-এর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল। সত্য বুঝতে পারার পরও জুলেখার সম্মান বাঁচাতে তাঁর স্বামী কিতফির ইউসুফ (আ.)-কে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। (কাসাসুল কোরআন, হিফজুর রহমান, অনুবাদ : মাওলানা আবদুস সাত্তার আইনী, খণ্ড ৩, পৃ ৩০)
জেলখানায় বন্দীরা ইউসুফ (আ.)-কে বেশ সমীহ করতেন। তিনি তাঁদের আল্লাহর পথে দাওয়াত দেন। কেউ কেউ তাঁর কথা মেনে নিয়েছিলেন। সে সময় মিসরের বাদশাহ এক স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের অর্থপূর্ণ ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারছিলেন না। জেলবন্দি ইউসুফ (আ.) সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বাদশাহ বেজায় খুশি হন। তাঁকে মুক্তি দেন। পরে তিনি মিসরের খাদ্যভান্ডার ও ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পান। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘রাজা বলল, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তাকে আমার জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে নেব। অতঃপর সে (ইউসুফ) যখন তার সঙ্গে কথা বলল, তখন রাজা বলল, আজ তুমি আমাদের কাছে খুবই মর্যাদাশীল ও বিশ্বস্ত হিসেবে পরিগণিত। সে (ইউসুফ) বলল, ‘আমাকে দেশের ধনভান্ডারের দায়িত্ব দেন, আমি উত্তম রক্ষক ও যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী।’ এভাবে আমি ইউসুফকে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম। দেশের যেখানে ইচ্ছা সে নিজের স্থান করে নিতে পারত। আমি যাকে চাই আমার রহমত দিয়ে ধন্য করি, আমি সৎকর্মশীলদের কর্মফল কক্ষনো বিনষ্ট করি না।’ (সুরা–ইউসুফ, আয়াত: ৫৪-৫৬)
অনেকের ধারণা, ইউসুফ (আ.) জুলেখার সঙ্গে প্রেম করেছেন—এটি সত্য নয়। এটি একটি প্রচলিত ভুল। জুলেখার একপক্ষীয় প্রেম ছিল। জুলেখার সঙ্গে ইউসুফ (আ.)-এর বিয়ে হয়েছিল কিনা—এ বিষয়ে কোরআন-হাদিস থেকে স্পষ্ট কিছুই জানা যায়নি। তবে কোনো কোনো মুফাসসির উল্লেখ করেছেন, স্বামী কিতফিরের মৃত্যুর পর এবং তওবা করার পর ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে জুলেখার বিয়ে হয়েছিল। (তাফসিরে ইবনে আবি হাতিম, খণ্ড ৮, পৃ ৩৯০; তাফসিরে তবারি, খণ্ড ১৬, পৃ ১৫১)
আবু আশফাক মুহাম্মাদ: লেখক ও আলেম