তিনি কলমকে বললেন, সময়ের শেষ পর্যন্ত লেখো
রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রথমে ছিলেন শুধুই আল্লাহ। তিনি ছাড়া আর কিছু ছিল না। এরপর আল্লাহ তায়ালা আরশ সৃষ্টি করলেন। আরশের পর সৃষ্টি করলেন কলম।’ মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘আল্লাহর আরশ পানির ওপর অবস্থিত।’
এই বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহর আরশের নিচে একটি পানির আবরণ বা অস্তিত্ব রয়েছে। সে সূত্রে কিছু বিজ্ঞ লোক মনে করেন, আল্লাহ সম্ভবত কলম তৈরির আগেই পানি তৈরি করেছেন। যদিও এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলার সুযোগ নেই, তখন আকাশ বা পৃথিবী কোনোটাই তৈরি হয়নি। আমরা দুনিয়াতে এসেছি তারও বহু পরে। তবে কোরআন থেকে জানা যায়, পানি হলো সকল জীবনের উৎস (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৩০)।
এবার কলমের প্রসঙ্গে আসা যাক। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ কলম সৃষ্টি করেছেন।’ এই কলমের আকৃতি বা এটি দেখতে কেমন তা আমাদের কল্পনার বাইরে। কিন্তু এই কলম আছে এবং এটি আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এতে অবিশ্বাসের সুযোগ নেই।
হাদিসে আছে, কলম সৃষ্টির পর আল্লাহ কলমকে বললেন, ‘লেখো।’ কলম বলে উঠল, ‘কী লিখব, হে আমার রব?’ আল্লাহ–তায়ালা বললেন, ‘কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে তার সবই লেখো।’ এরপর মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমি এই কলমের ব্যাপারে তোমাদের যা কিছু বলেছি তার বাইরে কেউ যদি অন্য কিছু বিশ্বাস করে, তাহলে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’
আরেকটি হাদিস থেকে পাওয়া যায়, এই কলম সৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগে। অর্থাৎ পৃথিবী ও আকাশে যা কিছু ঘটবে, তা বহু আগেই লেখা হয়ে গেছে। তো শেষ পর্যন্ত এই কলম কী কী লিখল?
প্রখ্যাত তাবেয়ী আবদুল ওয়াহেদ ইবনে সুলাইম (র.) বলেন, আমি একদিন কাবার বিখ্যাত মুফতি আতহ ইবনে আবি রাবাহ (রা.)–এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তখন ‘আল কাদারিয়া’ নামের একদল লোকের উদ্ভব হয়েছিল, যারা তাকদীরে বিশ্বাস করত না।
আমি তাকে বললাম, ‘হে মুফতি, মানুষ তো দিন দিন আল্লাহর তাকদীরকে অমান্য করে যাচ্ছে।’ তিনি আমাকে বললেন, ‘হে বৎস, তুমি কোরআন তিলাওয়াত করতে জানো?’ আমি বললাম ‘হ্যাঁ, জানি।’ ‘তাহলে আমাকে সুরা জুখরুফ পড়ে শোনাও।’
আমি তাকে কোরআন তিলাওয়াত শোনাতে লাগলাম এবং সুরা যুখরুফের এই আয়াতে পৌঁছালাম, ‘নিশ্চয়ই এটি (সংরক্ষিত) রয়েছে উম্মুল কিতাবে, যা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা পরিপূর্ণ।’
তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি কি জানো এই আয়াতে উম্মুল কিতাব বা কিতাবের জননী আসলে কি?’
আমি বললাম, ‘না, জানি না।’
তিনি বললেন, ‘এটিই সেই কিতাব যা আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগে লিখে রেখেছেন।’ এই কিতাবেই লেখা আছে, ফেরাউন জাহান্নামি, এবং আবু লাহাব ধ্বংস হোক।
ফেরাউন মুসা (আ.)–কে বলছিল, ‘তোমার আল্লাহর কথা যদি সত্য হয়, তাহলে আমার আগে যারা এসেছিল, তাদের ব্যাপারে কী বলবে? তাদের কাছে কোনো নবী আসেনি কেন? তখন মুসা (আ.) জবাব দিয়েছিলেন, ‘এ সকল জ্ঞান আমার রবের কিতাবে সংরক্ষিত আছে এবং আমার রব কখনো ভুলে যান না’ (সুরা ত্বহা)।
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার এই কলম পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টির বহু আগে যা কিছু ঘটবে তা লিখে রেখেছে। আর এখানে সংরক্ষিত যে কিতাবের কথা বলা হচ্ছে, সেটা হলো ‘লাওহে মাহফুজ’।
কোরআনের বিভিন্ন স্থানে ‘লাওহে মাহফুজ’–এর উল্লেখ আছে। আল্লাহ–তায়ালা এটিকে বলেছেন ‘কিতাবিন মুবিন’, ‘ইমামিন মুবিন’, অর্থাৎ এটি এমন কিতাব, যা সম্পূর্ণ স্পষ্ট। এটিকে বলা হয়েছে ‘কিতাবিন মাসতুর’ বা এমন কিতাব যা কেউ স্পর্শ করেনি। এমন কোনো জ্ঞান নেই, যা এর ভেতর নেই। এমনকি গাছ থেকে একটি শুকনো পাতা ঝড়ে পরলে সেই জ্ঞানটিও লিপিবদ্ধ আছে এই কিতাবে।
ইমাম শাফেয়ি (র.) একবার তার স্ত্রীর সঙ্গে সুন্দর সময় কাটাচ্ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই যে দেখ, তুমি যে আমার সারা জীবনের সঙ্গী হবে, তা আল্লাহ আকাশ সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগেই তোমার পাশে আমার নাম লিখে রেখেছেন।’ অর্থাৎ সবই লেখা রয়েছে এই লাওহে মাহফুজে।
লাওহে মাহফুজ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এর অবস্থান হলো বায়তুল মামুরে। আর এই বায়তুল মামুর অবস্থিত সপ্তম আসমানে, আল্লাহর আরশের নিচে।
লওহে মাহফুজের ওপরের অংশ আল্লাহর আরশের সঙ্গে সংযুক্ত। এর লেখাগুলো আলোর তৈরি। আল্লাহ প্রতিদিন এর দিকে দৃষ্টি দেন। তিনি যাকে ইচ্ছা মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, যাকে ইচ্ছা মর্যাদা কেড়ে নেন। তিনি যাকে ইচ্ছা ধনী করেন যদিও সে গরিব ছিল আবার যাকে ইচ্ছা নিঃস্ব করেন যদিও সে ধনী ছিল। তিনি যাকে ইচ্ছা মৃত্যু দেন আবার যাকে ইচ্ছা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন। তিনি যা ইচ্ছা, তাই করেন। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।
অনুবাদ: সাজিদ আল মাহমুদ