রুমির ‘মসনভি’তে কোরআনের মর্মবাণী
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির লেখা মসনভি শরিফকে পবিত্র কোরআনের ফারসি ভাষার তাফসির বলা হয়। কিন্তু এটি প্রচলিত অর্থে তাফসির নয়। এর চরিত্র অনন্য। কোরআনের ব্যাখ্যায় হাদিস বা মনীষীদের উদ্ধৃতি ব্যবহার না করে রুমি মসনভিতে অসংখ্য ছোট ছোট গল্প বলেছেন। গল্পের ভেতরে অন্য অনেক গল্পের অবতারণা করেছেন। মসনভির এই গল্পগুলো পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের মর্মবাণীকে তুলে ধরেছে।
ইরানিরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, মসনভি পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যা। পারস্যের বিখ্যাত কবি আবদুর রহমান জামি বলেছেন, ‘মসনভিয়ে মানাভিয়ে মাওলাভি/ হাস্ত কোরআন দার যাবানে পাহলাভি।’ অর্থাৎ মৌলভি রুমির আধ্যাত্মিক মসনভি যেন ফারসি ভাষায় লিখিত কোরআনের প্রতিফলন।
মসনভির প্রথম গল্পটি দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। গল্পটি একজন বাদশাহ ও একজন দাসীর। গল্পটি এ রকম: এক বাদশাহ শিকারের জন্য একদিন জঙ্গলে গিয়ে অপরূপ সুন্দরী এক দাসীকে দেখতে পেলেন। দেখামাত্র বাদশাহ তার প্রেমে পড়ে গেলেন। জঙ্গল থেকে দাসীকে ধরে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু রাজপ্রাসাদে এসে সেই দাসী অসুস্থ হয়ে নাওয়া–খাওয়া সব ছেড়ে দেয়। বাদশাহ দাসীর অসুস্থতায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। দাসীকে সুস্থ করার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হেকিম এনে দেখাতে থাকেন। কিন্তু কেউ দাসীকে সুস্থ করতে পারে না। বাদশাহ নিরাশ হয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। রাতে বাদশাহ স্বপ্নে দেখলেন, পরদিন সকালে রাজদরবারের দরজায় একজন বৃদ্ধ বিজ্ঞ হেকিম আসবেন। তিনিই এই দাসীকে সুস্থ করতে পারবেন। পরদিন সকাল হতেই একজন বৃদ্ধ হেকিম রাজদরবারে এলেন।
বাদশাহ হেকিমকে দাসীর অবস্থা সব বুঝিয়ে বললেন। হেকিম বললেন, আমিই এই অসুখের চিকিৎসা করতে পারব। হেকিম দাসীর সঙ্গে একান্তে কথা বলার অনুমতি চাইলেন। দাসীর সঙ্গে কথা বলে হেকিম জানতে পারলেন, জঙ্গলে থাকা অবস্থায় একজন স্বর্ণকার ছেলের সঙ্গে দাসীর প্রেম ছিল। সেই স্বর্ণকারের বিরহেই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হেকিম বাদশাহকে দাসীর বৃত্তান্ত সব জানালেন এবং ওই স্বর্ণকার ছেলেকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করলেন। হেকিমের অনুরোধে বাদশাহ সেই স্বর্ণকারকে অনেক টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে রাজদরবারে নিয়ে এলেন। স্বর্ণকারকে রাজদরবারে দেখামাত্র দাসী সুস্থ হয়ে গেল। আগের মতো আনন্দে রাজদরবারে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এবার হেকিম স্বর্ণকার ছেলের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিতে শুরু করলেন। বিষের প্রভাবে স্বর্ণকারের চেহারা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। স্বর্ণকার ছেলের চেহারা যতই নষ্ট হতে লাগল, দাসীর অন্তরে স্বর্ণকারের প্রতি প্রেমও তত কমে যেতে লাগল। আস্তে আস্তে দাসী বাদশাহর প্রেমের প্রতি আকৃষ্ট হলো। এভাবেই দাসী একদিন স্বর্ণকারকে ভুলে গিয়ে বাদশাহর মন জয় করে নিল।
গল্পটি শুনতে নিছক একটি প্রেমের রূপকথা মনে হলেও এই গল্পে পবিত্র কোরআনের দুটি আয়াতের প্রতিফলন দেখা যাবে। ঘটনাটি পবিত্র কোরআনের সুরা হাদিদের ২০ নম্বর ও সুরা কাহাফের ১৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখো, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, আত্মপ্রশংসা ও ধনে-জনে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর উপমা (সেই) বৃষ্টি, যা উৎপন্ন শস্যসম্ভার দিয়ে অবিশ্বাসীদের চমৎকৃত করে। তারপর তা শুকিয়ে যায়, আর তাই তুমি তাকে হলুদ বর্ণ দেখতে পাও। অবশেষে তা খড়কুটোয় পরিণত হয়। পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত: ২০)
কোরআনে আছে, আল্লাহ যাকে সৎ পথে পরিচালিত করবেন, সে সৎ পথ পাবে। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করবেন, আপনি তার জন্য পথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না। (সুরা কাহাফ, আয়াত: ১৮)
এই আয়াত দুটির ব্যাখ্যা রুমির এই গল্পে পাওয়া যাবে। এখানে তিনি বাদশাহকে স৶ষ্টার সঙ্গে এবং স্বর্ণকার ও দাসীকে একজন সালেক বা তরিকার পথের পথযাত্রীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। বৃদ্ধ হেকিমকে মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় উপস্থাপন করেছেন। রুমি বলতে চেয়েছেন: একজন মুর্শিদ তার সালেকের চোখে দুনিয়াকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন না করা পর্যন্ত সে আল্লাহর প্রেমিক হতে পারবে না। এখানে মুর্শিদরূপী হেকিম যখন সালেকরূপী দাসীর সামনে দুনিয়ারূপী স্বর্ণকারের চেহারাকে নষ্ট করে দিলেন, তখন সেই দাসী স্রষ্টারূপ বাদশাহর প্রেমের প্রেমিকা হয়ে গেলেন।
ড. আহসানুল হাদী: সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।