কবর মানে সমাধি। ইসলামি বিধানমতে, মৃত ব্যক্তির দেহ দাফন বা সমাধিস্থ করা হয়। কবর দেওয়ার জায়গাকে ‘কবরস্থান’ তথা সমাধিস্থল বলা হয়। ফারসিতে কবরকে গোর বলা হয় এবং কবরস্থানকে ‘গোরস্তান’ বলা হয়ে থাকে। মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে বারজাখ বা অন্তর্বর্তী সময় বলা হয়। বারজাখ জীবনকে সাধারণত কবর জীবন বলা হয়। কারণ, স্বাভাবিক অবস্থায় মৃতদেহ বা লাশ কবর দেওয়া হয়ে থাকে। যাদের বিশেষ কোনো কারণে দাফন হবে না, তাদেরও বারজাখ জীবন একই রকম হবে।
বারজাখ জীবন বা কবরে প্রত্যেক মানুষকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। এই প্রশ্ন করার জন্য যে ফেরেশতারা আসবেন, তাঁদের পরিচয় হলো ‘মুনকার-নাকির’। মুনকার-নাকির অর্থ হলো অপছন্দনীয় বা অযাচিত ও অবাঞ্ছিত। যেহেতু বারজাখবাসী ব্যক্তি প্রশ্নোত্তরকারী ফেরেশতাদের বিষয়ে অনাগ্রহী থাকবেন, তাই তাঁদের এমন পদবি। কবরের তিনটি প্রশ্ন আরবিতে এভাবে হবে: ‘মান রাব্বুকা? ওয়া মা দ্বীনুকা? ওয়া মান নাবিয়্যুকা?’ অর্থাৎ ‘তোমার রব কে? তোমার দ্বীন-ধর্ম কী? তোমার নবী কে?’ প্রশ্নের শেষাংশটি বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্নভাবে রয়েছে। যেমন ‘ওয়া মান হাজার রজুল?’ প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হবে, ‘এই ব্যক্তি কে?’ যঁাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল।
প্রতিটি মুহূর্তে সব চিন্তাচেতনায় ও কর্মসাধনায় আখিরাত বা পরকাল এবং বারজাখ বা কবর জীবনকে স্মরণ করে চললেই লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। অন্যায়, অপরাধ ও পাপ থেকে বেঁচে থাকা সহজতর হবে
বিশ্বাসী মুসলিম বা মুমিন বান্দা সঠিক উত্তর দেবেন, ‘আমার রব আল্লাহ, আমার ধর্ম ইসলাম, আমার নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)’ অথবা ‘ইনি হলেন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)।’ আর যারা পাপী, গুনাহগার ও অবিশ্বাসী—তারা বলবে, ‘হা! লা আদরি।’ ‘হায়! আমি কিছুই জানি না।’ আর পুণ্যবানদের সঠিক উত্তর শোনার পর বলা হবে, ‘তাকে জান্নাতি লেবাস-পোশাক পরিয়ে জান্নাতি বিছানা সাজিয়ে দাও এবং জান্নাতের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে দাও।’ আর উত্তর দিতে ব্যর্থ পাপী ও অবিশ্বাসীদের জাহান্নামের শাস্তি শুরু হয়ে যাবে।
জীবনমাত্রই মরণশীল। আল্লাহ কোরআন মাজিদে বলেন, ‘কুল্লু নাফসিন জায়িকাতুল মাউত’ অর্থাৎ ‘প্রত্যেক সত্তাই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)
দুনিয়ার জীবন আখিরাতের কর্মক্ষেত্র বা পরীক্ষাস্থল। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘বরকতময় তিনি, তাঁর হাতে রাজ্যক্ষমতা আর তিনি সব বিষয়ে শক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন; যাতে পরীক্ষা করবেন তোমাদের কাদের কাজ ভালো। আর তিনি পরাক্রমশীল ও ক্ষমাশীল।’ (সুরা-৬৭ মুলক, আয়াত: ১-২) তাই প্রতিটি মুহূর্তে সব চিন্তাচেতনায় ও কর্মসাধনায় আখিরাত বা পরকাল এবং বারজাখ বা কবর জীবনকে স্মরণ করে চললেই লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। অন্যায়, অপরাধ ও পাপ থেকে বেঁচে থাকা সহজতর হবে। নবীজি (সা.) বলেন, যারা সকাল–সন্ধ্যায় সাতবার করে এই দোয়া পাঠের মাধ্যমে মৃত্যুর পরের জীবনকে স্মরণ করবে, তাদের মুনকার-নাকিরের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ হবে, ‘রাদিতু বিল্লাহি রব্বাও ওয়া বিল ইসলামি দিনাও ওয়া বিমুহাম্মাদিন নাবিয়্যা।’ অর্থাৎ ‘আমি সন্তুষ্ট হলাম আল্লাহকে রব হিসেবে গ্রহণ করে, ইসলামকে দ্বীন-ধর্ম বা জীবন বিধানরূপে পালন করে এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে নবী হিসেবে বরণ করে।’
মূলত এটি কোনো উত্তর মুখস্থ করা নয়। এমনকি এটি কোনো গুণকীর্তন, স্তুতিবাক্য, দোয়া বা প্রার্থনাও নয়; বরং কালেমাটি এমন একটি ঘোষণা বাক্য, যার মাধ্যমে আমরা পরকালের স্মরণ ও সে মর্মে কর্মসাধনের প্রত্যয় ব্যক্ত করি ও উদ্দীপনা লাভ করি। আমাদের বিশ্বাস, আচার–আচরণে, কাজে–কর্মে যদি উক্ত বিশ্বাসের প্রতিফলন থাকে, তবেই ওই তিন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভবপর হবে; অন্যথায় নয়।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম