হিজরতকারীদের ফেরত আনার জন্য কোরাইশরা আবিসিনিয়ায় লোক পাঠাল: ১
কোরাইশরা দেখল রাসুলে করিমের (সা.) অনুগামীরা আবিসিনিয়ায় বেশ স্বাচ্ছন্দে্যর সঙ্গে নিরাপদে জীবন যাপন করছেন। তখন তারা ঠিক করল তাদের দুজন শক্ত-সমর্থ লোক পাঠাবে নিগাসের কাছে। নিগাসকে তারা বলবে, ওদের ফেরত পাঠানোর জন্য। উদ্দেশ্য তাঁদের ধর্ম ত্যাগের জন্য প্ররোচিত করা এবং তাঁদের শান্তিতে জীবনযাপনের গৃহ ভেঙে দেওয়া। তারা আবদুল্লাহ্ ইবনে আবু রাবিয়া এবং আমর ইবনে আল-আস ইবনে ওয়াইলকে পাঠাল। তারা সঙ্গে নিয়ে গেল নিগাস আর তাঁর সভাসদদের জন্য কিছু উপহার। আবু তালিব তাদের এই পরিকল্পনা টের পেয়ে গেলেন। নিগাসের উদ্দেশে তখন তিনি নিম্নোক্ত কবিতা রচনা করেন, যাতে নিগাস তাঁদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেন, তাঁদের রক্ষা করেন:
রাসুলে করিম (সা.) স্ত্রী উম্মে সালমা বিনতে আবু উমাইয়া ইবনে আল-মুগিরার সূত্রে আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আল-হারিস ইবনে হিশাম আল-মাখজুমি এবং তাঁর সূত্রে মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম আল-জুহরি বলেছেন:
আবিসিনিয়া পৌঁছালে নিগাস আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। নিরাপদে আমরা ধর্মকর্ম করে যেতে লাগলাম, আমরা আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগি করি, কথায় বা কাজে কেউ আমাদের কোনো ক্ষতি করে না। কোরাইশরা এই সংবাদ জানতে পারল। তারা ঠিক করল, দুজন দৃঢ়চেতা লোক পাঠাবে নিগাসের কাছে, মক্কার সবচেয়ে সুন্দর জিনিস পাঠাবে তাদের সঙ্গে উপহার হিসেবে। মক্কার চামড়ার সামগ্রী তখন খুব প্রসিদ্ধ। নিগাসের সভাসদদেরও উপহার দেওয়ার জন্য তারা সঙ্গে করে অনেক চামড়ার সামগ্রী নিল। তারা পাঠিয়েছিল আবদুল্লাহ্ ও আমরকে। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, শরণার্থী প্রসঙ্গে নিগাসের সঙ্গে কিছু বলার আগেই যেন সভাসদদের উপহার দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তারা দেবে নিগাসের উপহার। সভাসদদের সঙ্গে কথা বলার আগেই তাঁকে অনুরোধ করবে তাদের লোকজনকে ফেরত দেওয়ার জন্য।
এই নির্দেশ আবদুল্লাহ্ এবং আমর অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করল। প্রত্যেক সভাসদকে তারা বলল, ‘রাজার দেশে এসে আমাদের কতগুলো নির্বোধ লোক আশ্রয় নিয়েছে। তারা আমাদের ধর্ম ত্যাগ করেছে, আবার আপনাদের ধর্ম গ্রহণ করেনি। তারা এমন এক নবাবিষ্কৃত ধর্ম নিয়ে এসেছে, যার সম্পর্কে আপনি বা আমরা কেউ কিছু জানি না। আমাদের নেতারা আপনাদের রাজার কাছে আমাদের পাঠিয়েছেন তাদের ফেরত দেওয়ার নিমিত্তে রাজাকে অনুরোধ করার জন্য। কাজেই আমরা যখন রাজাকে বলব তাদের ফেরত দেওয়ার জন্য, তখন অনুগ্রহপূর্বক রাজাকে বলবেন শরণার্থীদের আমাদের কাছে সমর্পণ করার জন্য। বলবেন, রাজা যেন তাদের সঙ্গে কোনো কথা না বলেন। কারণ ওদের লোকজনের ভীষণ অন্তদৃর্ষ্টি আর নিজেদের দোষ-ত্রুটির কথা তারা খুব ভালো করে জানে।’
সভাসদেরা তাদের কথায় রাজি হলো। তারপর তারা উপঢৌকন নিয়ে গেল রাজার কাছে। রাজা উপঢৌকন গ্রহণ করার পর যা তারা বলেছিল সভাসদদের কাছে শরণার্থীদের সম্পর্কে, রাজাকেও তা বলল। মুসলমানদের বক্তব্য রাজা নিগাস শুনুক এটা কিছুতেই আবদুল্লাহ্ এবং আমর চায় না। উপস্থিত সভাসদেরা বলল, ‘ওরা যা বলছে ঠিকই বলছে, ওদের দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের খবর ওদেরই ভালো জানার কথা।’ সুতরাং, তারা রাজার কাছে সুপারিশ করল, রাজা যেন তাদের এদের কাছে সমর্পণ করেন, যাতে এরা তাদের আপনজনদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
নিগাস ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। বললেন, ‘না, আল্লাহ্র কসম, তাদের আমি ফেরত দেব না, যারা আমার আশ্রয় চেয়েছে, আমার রাজ্যে ঘর বেঁধেছে, অন্যকে ফেলে আমার কাছে এসেছে, তাদের সম্পর্কে এই দুজন যা বলছে, সে সম্পর্কে তাদের ডেকে তাদের সঙ্গে কথা না বলে আমি তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। এরা যা বলছে তা-ই যদি হয়, তাহলে ওদের আমি দিয়ে দেব, ওদের ফেরত পাঠাব নিজেদের লোকের কাছে। কিন্তু ওদের কথা যদি মিথ্যা হয়, তাহলে আমি তাদের রক্ষা করব, আমার আশ্রয়ে তাদের সমস্ত সুখ-সুবিধার বন্দোবস্ত করে দেব।’
তিনি তখন রাসুলে করিমের (সা.) সঙ্গীদের ডাকলেন। রাজার দূত সমন নিয়ে এল তাঁদের কাছে। তাঁরা একত্রে জমায়েত হলেন, পরস্পরকে বললেন, ‘কী বলবে তুমি তাঁর কাছে গিয়ে?’ তাঁরা বললেন, ‘আমরা যা জানি তা-ই বলব, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) আমাদের যা বলতে বলেছেন, তা-ই বলব, তা যা-ই ঘটুক কপালে।’ রাজার দরবারে এসে তাঁরা দেখলেন রাজ-পুরোহিতেরা ওখানে তাঁদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ খুলে বসে আছেন। রাজা তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, কী তাঁদের এমন ধর্ম, যার জন্য তাঁরা স্বজন-স্বদেশ পরিত্যাগ করেছেন অথচ তাঁর কিংবা অন্য কারও ধর্মও গ্রহণ করেননি তাঁরা।
অনুবাদ: শহীদ আখন্দ
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)’ বই থেকে