রুমি ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ৫৪ বছর বয়সে মসনভি গ্রন্থটি লিখতে শুরু করেন। ১২৭৩ সালে তাঁর ইন্তেকালের আগপর্যন্ত এ লেখা চলতে থাকে। রুমির শিষ্য হোসামুদ্দিন চালাবি মসনভির শ্লোকগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। পরে তিনিই এই গ্রন্থ প্রকাশ করেন। মসনভি শরিফ ছয় খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে নফসের কুমন্ত্রণা ও কু–অভ্যাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডে জ্ঞান ও কর্মের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডে মহান আল্লাহ তায়ালার ঐশ্বরিক অস্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
মসনভির প্রথম খণ্ডেই রুমি একজন বোকা শিকারির গল্প বর্ণনা করেছেন। শিকারিটি সারা দিন বনের পশুপাখি শিকারের পেছনে ঘুরে বেড়াতেন এবং রাতেও শিকারের স্বপ্ন দেখেন। একদিন শেষরাতে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। জোছনার আলোতে চারদিক আলোকিত থাকায় তিনি ভাবেন, সকাল হয়েছে।
তির-ধনুক হাতে তিনি শিকার করতে বেরিয়ে যান। খুব কাছেই মাটির ওপর দিয়ে অদ্ভুত একটি পাখিকে তিনি দৌড়ে যেতে দেখেন। শিকারি ধনুক হাতে ওই পাখির পেছনে ছুটতে ছুটতে তির মারতে থাকেন। শিকারি বারবার পাখিটির দিকে তির ছুড়লেও পাখি তিরবিদ্ধ হচ্ছিল না। তিনি তাঁর চেষ্টা চালাতে থাকেন, কিন্তু কোনোভাবেই শিকারটি জব্দ হচ্ছিল না। এরই মধ্যে সকাল হয়ে গেলে পূর্বের আকাশ ফরসা হয়ে যায়। শিকারি বুঝতে পারেন, এতক্ষণ যে শিকারের পেছনে তিনি ছুটছিলেন, সেটি আসল শিকারের ছায়ামাত্র, মূল শিকার তাঁর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। শিকারের মোহে তিনি এতই মত্ত ছিলেন যে তাঁর দৃষ্টি কেবল জমিনের ছায়ার দিকেই নিবিষ্ট ছিল, ওপরে তাকানোর ফুরসত তিনি পাননি। এখন আসল শিকারকে তির মারতে গেলে শিকারি বুঝতে পারেন যে তাঁর সব তির শেষ হয়ে গেছে। এই ভেবে হতাশায় তাঁর মন ভরে উঠল যে যখন আসল শিকারকে চেনা গেল, তখনই আমার তির ফুরিয়ে গেল।
রুমি বলেন, ‘তির আন্দা’ জাদ জেসুয়ে সা’য়ে ঊ/ বিখাবার কে আসলে অ’ন সা’য়ে কুজাস্ত/ তারকাসে ওমরাস তুহি শুদ ওমর রাফত/ আজ দাওয়িদান দার শেকা’রে সা’য়ে তাফত।’ অর্থাৎ ছায়ার দিকে একের পর এক তির ছুড়তে ছুড়তে শিকারের খোঁজে তিরদানি নিঃশেষ হয়ে গেল। হায়াতের তিরদানি খালি হলো, জীবন ফুরিয়ে গেল; ছায়া শিকারের পেছনে ছুটতে ছুটতে সবই হারাতে হলো।
রুমি এখানে পার্থিব জীবনকে ছায়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং ভোগবাদীদের প্রকৃত অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। বস্তুবাদীরা কল্পনার প্রভাবে ছায়াকে কায়া আর অবাস্তবকে বাস্তব বলে মনে করেন। এভাবে হাসি আর খেল-তামাশায় জীবন অতিবাহিত করার পর যখন জীবনসায়াহ্নে পৌঁছায়, তখন হয়তো জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন, কিন্তু সে সময় পরকালের জন্য কিছু করার ক্ষমতা আর তার থাকে না। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য যাঁদের ওপর আল্লাহর ছায়া বিস্তৃত আছে, তাঁদের সান্নিধ্যে যেতে হবে বলে রুমি মনে করেন।
রুমি বলেন, ‘সয়েয়ে য়াজদান চো বা’সাদ দা’য়েআস/ ওয়া রাহা’নাদ আজ খায়া’ল ও সা’য়েআস/ সা’য়ায়ে য়াজদান বুওয়াদ বান্দেয়ে খোদা/ মুরদায়ে ইন আ’লাম ও জেন্দেয়ে খোদা।’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর ছায়া যদি কারও ওপর প্রসারিত হয়; কল্পনার ছায়া থেকে মানুষকে উদ্ধারকারী তাঁরাই হয়।’
আল্লাহর ছায়া বলতে সেই বান্দাকে বোঝায়, যিনি ভোগবাদীতায় মৃত আর আল্লাহতে জীবন্ত। রুমি এখানে সুরা ফুরকানের ৪৫ নম্বর আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি কি দেখেননি, আপনার রব কীভাবে তাঁর ছায়াকে বিস্তৃত করেছেন। এই বিস্তৃত ছায়া যাঁরা লাভ করেন, তাঁরাই ইনসানে কামেল তথা অলি-আউলিয়ায় রূপান্তরিত হন।’
রুমি আরও বলেন, ‘দ’ মানে উ গীর জু তার বি গুমান/ তা’ রাহি আজ অ’ফাতে আ’খের জামা’ন।’ অর্থাৎ সংশয়মুক্ত হয়ে জলদি তাঁদের আঁচল ধরো, তাহলেই শেষ জমানার ফেতনা থেকে মুক্ত হতে পারবেন।
আমরা যাঁরা দুনিয়ার মোহ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারছি না, রুমির পরামর্শ হচ্ছে, তাঁরা যেন দেরি না করে খুব শিগগির একজন হক্কানি অলি-আউলিয়ার শরণাপন্ন হন। একমাত্র একজন অলির সহবতের মাধ্যমেই তিনি অন্তরের রোগ থেকে মুক্তি পেয়ে আল্লাহর পথে ধাবিত হতে পারেন।
ড. আহসানুল হাদী, সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়