মহানবী (সা.)-র জীবনের শেষ ১৫ দিন

ষষ্ঠ দিন: ৩ রবিউল আউয়াল, ৩০ মে, শনিবার

প্রবল জ্বর ও মাথাব্যথার কারণে নবীজি কাতর হয়ে পড়েন এবং ভীষণ যন্ত্রণা পেতে থাকেন। হঠাৎ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং তারপর আবার জ্ঞান ফিরে পান। শুধু নামাজের জন্য বাইরে আসেন এবং পরে আবার বিছানায় ফিরে যান।

ওসামা ইবনে জায়েদের নেতৃত্বের আপত্তি সম্পর্কে ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) জানতে পারেন এবং আপত্তিকারীদের তিনি বিরোধিতা করেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি নিজে নবীজির (সা.) কাছে এই খবর জানান। মাথায় ব্যথার কারণে নবীজির (সা.) মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল। এ অবস্থায়ও তিনি বাইরে বেরিয়ে আসেন এবং মিম্বরে বসেন।

প্রথমে তিনি আল্লাহর নামে হামদ ও সানা পাঠ করে বলেন, ‘লোকসকল, ওসামা ইবনে জায়েদের নেতৃত্ব সম্পর্কে তোমাদের কিছু কথা শুনেছি। শপথ খোদার, তোমরা যদি ওসামার নেতৃত্ব নিয়ে আপত্তি করো, তাহলে তোমরা তার পিতার নেতৃত্ব নিয়েও তো আপত্তি করবে। শপথ করে বলছি, সে নেতৃত্বের উপযুক্ত ছিল এবং নেতৃত্বের যোগ্য তার ছেলেও। সে ছিল আমার প্রিয় ব্যক্তিদের একজন, ওসামাও আমার প্রিয়। তারা দুজনেই যাবতীয় ভালোর উপযুক্ত। তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো, কারণ সে তোমাদের একজন সেরা মানুষ।’ তিনি মিম্বর থেকে নেমে এলেন, ওসামা এবং লোকজন দ্রুত যুদ্ধের প্রস্তুতিতে লেগে গেল। (বুখারি, হাদিস ৪,২৫০; মুসলিম, হাদিস ২,৪২৬; ইবনে হিব্বান, ১০/৫৩৫)

আরও পড়ুন

সপ্তম দিন: ৪ রবিউল আউয়াল, ৩১ মে, রবিবার

রোগযন্ত্রণা বাড়তে থাকে। তিনি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েন। স্ত্রীদের জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি আগামীকাল কোথায় থাকব? আমি আগামীকাল কোথায় থাকব?’ তাঁর প্রশ্নের তাৎপর্য তারা বুঝতে পারেন। বলেন, ‘আপনি যেখানে থাকতে ইচ্ছা করে, সেখানেই থাকবেন।’

সে সময় তিনি মায়মুনা (রা.)-র ঘরে ছিলেন। সে-ঘরে সকল স্ত্রীকে ডেকে পাঠান এবং অসুখের দিনগুলি আয়েশা (রা.)-র ঘরে থাকার অনুমতি চান তাদের কাছে। সকলেই সন্তুষ্টচিত্তে অনুমতি দেন। ফজল ইবনে আব্বাস ও আলী (রা.)-র সাহায্যে বের হন। তাঁর মাথায় তখনও ফেটি বাঁধা। তিনি পা টেনে টেনে চলছিলেন। এভাবেই আয়েশার (রা.) ঘরে যান।’ (বুখারি, হাদিস: ৪,৪৪২)

ওদিকে ওসামা ইবনে জায়েদ (রা.) বাহিনীসহ রওনা হয়ে যান এবং মদিনা থেকে তিন মাইল দূরের জুরুফে ছাউনি ফেলেন। নবীজির (সা.) অসুস্থতার পরবর্তী অবস্থা কোথায় পৌঁছায় তা বুঝতে তাঁরা গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করেন।

অষ্টম দিন: ৫ রবিউল আউয়াল, ১ জুন, সোমবার

নবীজি (সা.)-এর জ্বর ও মাথাব্যথা আরও বাড়ে। তিনি বিছানায় তড়পাচ্ছিলেন। আয়েশা (রা.) তাঁকে বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, আপনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন, আমাদের মধ্যে কেউ এমন করলে আপনি অবাক হতেন!’ তিনি বলেন, ‘মুমিনদের ওপর কঠোরতা করা হয়, কারণ, কোনো মুমিন যদি একটি কাঁটাও পায়, আল্লাহ তার মাধ্যমে তার একটি গুনাহ মাফ করেন এবং তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন।” (বুখারি, হাদিস ৫,৩৭২; ফাতহুল বারি, ১০/১০৮)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) তাঁকে দেখতে আসেন। মাথায় হাত রেখে তিনি জ্বরতাপ অনুভব করেন। উত্তাপের দরুণ তিনি হাত ধরে রাখতে পারছিলেন না। বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, আপনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন।’ নবীজি (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি তোমাদের দুজনের সমান কষ্ট পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আপনার পুরস্কারও দ্বিগুণ।’ নবীজি (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ, শপথ খোদার, পৃথিবীর কোনো মুসলিম যদি কোনো কষ্ট পায়, আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করেন এবং তার মর্যাদা উন্নীত করেন—যেমন গাছের পাতা ঝরে পড়ে (আবার নতুন পাতা গজায়)।’ (বুখারি, হাদিস: ৫,৬৪৮)

আরও পড়ুন

নবম দিন: ৬ রবিউল আউয়াল, ২ জুন, মঙ্গলবার

‘জ্বর কমছিল না। অসুস্থতা বাড়ছিল। পরিবারের সদস্যদের বলেন পানি ঢেলে তাপ কমাতে। প্রায়ই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং প্রতিবার জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি বলেন, ওসামার বাহিনিকে যাত্রা করতে বলো।’ (তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ২/১৮৯)

আয়েশা ও ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘সময় ঘনিয়ে এলে নবীজি (সা.) তাঁর কাছে থাকা একটি কালো পাড়যুক্ত চাদর কখনো চোখমুখে রাখছিলেন, কষ্ট বেশি হলে আবার সেটা ফেলে দিচ্ছিলেন। এ-সময় তিনি বলেন, “ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ, নবীদের সমাধিগুলো তারা ধর্মঘর বানিয়েছে।” তিনি মুসলিমদের এ থেকে সতর্ক করছিলেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৪,৪৪৩-৪,৪৪৪)

এরপর তিনি অন্তিম উপদেশ দিতে বলেন, তারা যেন ওসামার বাহিনী ঠিক সেভাবে পাঠায় যেভাবে তিনি পাঠাতেন এবং জাজিরাতুল আরবে তারা যেন দ্বিতীয় কোনও দীনের অবকাশ না রাখে। তিনি এ-ও বলেন, কাফির-মুশরিকদের এখান থেকে বের করে দেবে। (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস ৪৪৩১)

আরও পড়ুন

দশম দিন: ৭ রবিউল আউয়াল, ৩ জুন, বুধবার)

নবীজি (সা.)-র অবস্থা শোচনীয় হলে পরিবারের সদস্যরা তাকে লাদ্দানি (একপ্রকার ওষুধ) দেন। তাঁর কাছে অত্যন্ত তিক্ত লাগে। জ্ঞান ফিরে পেলে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা আমার সঙ্গে কী করেছ?’ তাঁরা বলেন, ‘আপনাকে ওষুধ দিয়েছি।’ নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমি কি বলিনি যে আমার মুখে কোনো ওষুধ দেবে না? আমাকে লাদ্দানি দিয়েছ, অথচ আমি রোজা রেখেছি।’ তাঁরা বললেন, ‘আমরা ভাবলাম, রোগীরা তো ওষুধ পছন্দ করে না, তা-ই বলেছেন।’ এরপর তিনি বললেন, ‘আমার চাচা আব্বাস বাদে ঘরের প্রত্যেককে এই ওষুধ খাওয়াও।” সবাই খায়, এমনকি যারা রোজা রেখেছে তারাও। (বুখারি, হাদিস: ৪,৪৪২)

কিছুটা সুস্থ বোধ করার পর বলেন, ‘বিভিন্ন কুয়ার সাত পানির কলস আমার ওপর ঢেলে দাও। আমি লোকজনের কাছে গিয়ে কথা বলব।’ তাঁকে হাফসা (রা.)-র ঘরে একটি পানির টিউবে বসানো হয় এবং তাঁর মাথায় পানি ঢালা হতে থাকে, এক সময় তিনি বলেন, ‘হয়েছে, হয়েছে।’ (সুনান আদ-দারেমি, হাদিস ৮১; সহিহ আল-বুখারি, হাদিস ৪৪৪২)

এরপর তিনি আলী ও আব্বাসের সহায়তায় বাইরে আসেন, তাঁর মাথায় তখনো ফেটি বাঁধা। তিনি মিম্বরে বসেন। উহুদের যুদ্ধে নিহত শহীদদের জন্য প্রার্থনা করেন। এরপর বলেন, ‘আল্লাহ তার এক বান্দাকে দুনিয়া কিংবা তার (আল্লাহর) কাছে যা আছে—এ-দুটির মধ্যে বেছে নিতে বললেন। বান্দা নিলেন আল্লাহর কাছে যা আছে তা।’ আবু বকর (রা.) বুঝতে পারলেন যে নবীজি (সা.) নিজের কথাই বলছেন। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, ‘আমাদের জীবন ও সন্তান আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক।’ উপস্থিতিরা ফিসফিস করছিল, ‘আবু বকর (রা.) কেন কাঁদছেন?’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমার বন্ধুর বিষয়টি রাখো।’ তারপর বললেন, ‘আবু বকর, থামো, অস্থির হয়ো না। এমন কেউ নেই, যার জীবন ও সম্পদ আমাকে আবু বকরের চেয়ে বেশি উপকৃত করেছে। যদি কোনো মানুষকে বন্ধু বানাতাম, তাহলে তা আবু বকর (রা.)। কিন্তু ইসলামের বন্ধুতাই সর্বোত্তম। এই মসজিদের সব জানালা বন্ধ করে দাও, খোলা থাক শুধু আবু বকরের জানালা।’ (বুখারি, হাদিস: ৪৬৭)

আরও পড়ুন