মহাশক্তির মহামায়া
‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নম নমঃ।’
দেবী দুর্গা মাতৃরূপে, পিতৃরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে ও বিদ্যারূপে আবির্ভূতা এক মহাশক্তি। তিনি সম্মিলিত দেবশক্তির প্রতীক। অসুর, অর্থাৎ অপশক্তি বিনাশে দেবতাদের সম্মিলিত শক্তিতে সৃষ্টি করেন মহাশক্তি মহামায়া। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবী দুর্গা মহাশক্তিরই প্রতীক। সেই মহাশক্তিকেই ভক্তরা প্রতিমার মধ্য দিয়ে চিন্ময়ী ব্রহ্মশক্তিকে দর্শন করেন।
এ পূজা তাই প্রতিমাকে পূজা করা নয়, প্রতিমাতে পূজা করা। যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলতেন, চিকের আড়ালে দেবী সর্বদাই রয়েছেন। চিকের আড়ালে যিনি আছেন, তিনি মহাশক্তি দেবী দুর্গা। ভক্তদের অনুভবে ‘চিকের’ আড়ালে থাকা মহাশক্তি ভক্তদের দুর্গতি নাশ করে, তাই তিনি দুর্গা।
আধ্যাত্মিক ভাবনা দুর্গা কাঠামোতে অন্তর্নিহিত। দুর্গার ১০ হাত ১০ দিক রক্ষা করার প্রতীক, ১০ প্রহরণ একেক দেবতার সাধনলব্ধ বিভূতি। দেবী ত্রিগুণাত্মিকা শক্তির প্রতীক, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের প্রতীক। দেবী ত্রিনয়নী। একটি নয়ন চন্দ্রস্বরূপ, একটি সূর্যস্বরূপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরূপ। দুর্গার ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় ত্রিকাল। দেবী সিংহবাহনা—তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ। মহিষাসুর—দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্যের ঘনীভূত মূর্তি মহিষাসুর। শিব—সর্বোপরি অধিষ্ঠিত শিবমঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক। দেবীর ডান পাশে ওপরে লক্ষ্মী—ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তির, গণেশ—ধনশক্তির বা শূদ্রশক্তির, সরস্বতী—জ্ঞানশক্তি বা ব্রহ্মণ্যশক্তির, কার্তিক—ক্ষত্রিয়শক্তির প্রতীক। শক্তিগুলো অনুভূতির বিষয়, অনুভূতির আকার নেই। আকার দেওয়া হয়েছে মানুষের বোঝার সুবিধার জন্য। সব শক্তিই ব্রহ্মশক্তি। সাধকের হিতার্থে ব্রহ্মের নানান রূপকল্পনা।
দুর্গাপূজা মূলত অনুষ্ঠিত হয় মার্কণ্ডেয় পুরাণের ভিত্তিতে—দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ, বৃহৎ নন্দিকেশ্বরপুরাণ, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, দেবী ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থের ভিত্তিতে। এ গ্রন্থগুলো অনেক পুরোনো। তার থেকে নির্বাচিত ৭০০টি শ্লোক নিয়ে যে সংক্ষিপ্ত মার্কণ্ডেয় পুরাণ করা হয়েছিল, তাকেই বলা হয় ‘দুর্গাসপ্তশতী’, কথ্য ভাষায় বলা হয় শ্রীশ্রী চণ্ডী। শ্রীশ্রী চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গ নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গ অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গকে বধ করে যিনি স্বর্গ–বিতাড়িত দেবদের হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন, তিনি মা দুর্গা। এ ছাড়া মহিষমর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারী, বাহারী, চণ্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবানী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে মায়ের পূজা হয়ে থাকে।
আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার পূজা হয়ে থাকে। ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প, অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষ বা বিল্বশাখায়। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়া বেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়। প্রচলিত ভাষায় একে বলে কলাবউ। অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে ৪৮ মিনিটে দেবীর বিশেষ পূজা ‘সন্ধিপূজা’ হয়। অষ্টমী তিথিতে কোনো কুমারী বালিকাকে পূজা করা হয়। নবমীতে হোম যজ্ঞের দ্বারা পূজার পূর্ণাহুতি দেওয়ার রীতি। দশমী তিথিতে হয় দেবীর বিসর্জন। এই দশমী তিথি বিজয়া দশমী নামে খ্যাত।
মহাশক্তির আধার দেবী দুর্গা দেহ দুর্গের মূল শক্তি। মানুষের দেহও একটি দুর্গবিশেষ। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম—এই পঞ্চভূতে দেহ নির্মিত। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য—এই ষড়্রিপু আক্রমণ করে দেহের মূল শক্তি প্রাণশক্তিকে। শুধু দেহলাভ নয়, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড প্রাণই শ্রেষ্ঠ। উপনিষদে এই প্রাণেরই জয়গান। প্রাণ ব্রহ্ম সনাতন। প্রাণের স্বরূপ বিকশিত হয় সাধনায়। প্রাণশক্তির উদ্বোধনে, উপলব্ধিতে সাধক হন মহাশক্তিধর। প্রাণশক্তি-সাধনশক্তি বোধগম্য করার জন্য ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ পরিকল্পনা করে গেছেন ঋষিরা। ‘সাধকানাং হিতার্থ্যয় ব্রহ্মনো রূপ কল্পনা।’ সনাতন ধর্মেও পূজা অনুষ্ঠানে এবং বিভিন্ন প্রতিমার রূপকল্পনায় মূল শক্তি আত্মশক্তি, প্রাণশক্তিকে অনুভব করার ঋষি পরিকল্পনা, আত্মজিজ্ঞাসু মানুষের জন্য আধ্যাত্মিক পথনির্দেশ। প্রতিমা এবং তাতে পূজা উপলক্ষে আত্মসাক্ষাৎকার। উপনিষদের মহাবাণী—‘আত্মানং বিদ্ধি’—আত্মাকে জানো। কঠোপনিষদে যম নচিকেতাকে বলেছিলেন, ‘ওঠো, জাগো, শ্রেষ্ঠকে লাভ করে প্রবুদ্ধ হও।’ দুর্গাপূজা শ্রেষ্ঠত্বকে লাভ করার জন্য। উদ্দেশ্য মহাশক্তির আত্মসাক্ষাৎকার।
তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ।