...পরাণপুতলি উমা যে আমার
আসি বলে গেল, আসিল না আর
আমি নিবারি কেমনে নয়নের জল
না হেরি আমার নয়নতারারে ।।
দাশরথি রায়, আগমনী গান
উত্তর ভারতের পিতৃকেন্দ্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে দুর্গাকে স্বাধীনা, স্বাধিকারপ্রমত্তা অনার্য দেবী হিসেবে দেখা হতো। পরবর্তীকালে এই দেবীর মধ্যে আবহমান 'ভারতীয়' ভার্যা ও কন্যার ভাবমূর্তিটি সঞ্চারিত করা হয়েছিল। প্রয়াসটিকে অনার্য মূল্যবোধের ওপর আর্য প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার একটি কৌশল হিসেবে ধরা যেতে পারে। আমাদের সংস্কৃতিতে এই ঘটনাটির রীতিমতো জলবিভাজক তাৎপর্য আছে। এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য একাকী, যুদ্ধপটিয়সী দেবী দুর্গাকে বড় মূল্য দিতে হয়েছিল। তিনি আর্য মতের সমঞ্জস 'বিবাহ' নামক একটি গুরুতর সামাজিক বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
তাঁকে ইচ্ছেমতো 'চালনা' করতে পারা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য সমাজের একটি বৃহৎ কৃতিত্ব ছিল। মূল 'পার্বতী' দেবী দুর্গার কোনো পুরুষ অভিভাবক সঙ্গী ছিলেন না। তিনি কারও ভার্যা বা দুহিতাও ছিলেন না। আর্য স্বভাব-মানচিত্রের বাইরে থাকা একজন স্বাধীনা নারী ছিলেন তিনি। প্রথমে পুরাণ, তারপর তান্ত্রিক পরম্পরার ভেতর দিয়ে এসে এই দেবীকে শিব বা মহাদেবের বিবাহিত ভার্যা হয়ে পরিচিত হতে হয়েছিল। তন্ত্র সাহিত্য পরম্পরায় জগতের চালিকা শক্তি হিসেবে এই দেবীকে স্বীকৃতি দেওয়া হতো। যদিও মৌল পরিচয়ে তিনি ছিলেন শিবের শক্তি। তাঁর কোনো একক অস্তিত্ব ছিল না। ভারতবর্ষের সর্বত্র শিব ভার্যা ও গণেশ জননী হিসেবে তাঁর লোকপ্রিয় একটি ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।
দেবী দুর্গাকে নিয়ে বাঙালির সৃজনশীলতা এখানেই থেমে যায়নি। তাঁরা অনেক দিন ধরেই দেবীকে মাতারূপে আরাধনা করতেন। তার পাশাপাশি বহু মানুষ তাঁকে কন্যারূপে দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। দেবীর নানা 'পারিবারিক' সম্পর্ককে ভিত্তি করে চার-পাঁচ শ বছর ধরে তাঁর বহুস্তরীয় পরিচয় গড়ে উঠেছিল। তিনি আদি যুদ্ধ দেবীর রূপ থেকে অব্যাহতি পেয়ে গৃহস্থি ঘরনির রূপ পরিগ্রহ করেন। যথা হিমালয়কন্যা, শিব ভার্যা ও গণেশ জননী।
পরবর্তীকালে তাঁর ‘সন্তান’ হয়ে এসেছিলেন কার্তিকেয়, লক্ষ্মী বা সরস্বতী। এসব দেবতার সঙ্গে দুর্গার প্রথম যুগে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে মানুষ তাঁদের 'জননী' হিসেবে দুর্গাকে দেখতে চেয়েছে। ইতিহাস অনুযায়ী সরস্বতী তাঁর থেকে প্রাচীনা দেবী। আর্য দেবী হিসেবে লক্ষ্মীর মহিমাও দুর্গার পূর্ববর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পুরাণযুগে লক্ষ্মী ও দুর্গা উভয়েই একযোগে 'বিষ্ণু মায়া'র প্রকাশ ছিলেন। এত বিষম ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্মীকে দেবী দুর্গার দুহিতারূপে দেখতে চাওয়ার স্পৃহা বঙ্গীয় পারিবারিক আবেগের একটি নির্ভুল নমুনা।
‘… দুর্গা দুর্গতিনাশিনীই হোন, দুর্গাসুরনাশিনীই হোন বা দুর্গ রক্ষিণীই হোন, তিনি শস্ত্রধারিণী এবং অরি মর্দিনী; কিন্তু পার্বতী উমার কোনো প্রাচীন উল্লেখের মধ্যেই আমরা এই শস্ত্রধারিণী, অরি মর্দিনী রূপের উল্লেখ পাই না। উমাকে প্রথম পাইলাম কন্যারূপে—বহুশোভমানা হৈমবতী-রূপে। তাহার পরে পাইলাম শিবপ্রিয়া-রূপে, তাহার পরে পাই গণেশ-জননী ও কুমার-জননী-রূপে। তাহার পরে যখন লক্ষ্মী-সরস্বতীও তাঁহাদের স্বাতন্ত্র্য বর্জন করিয়া মায়ের কন্যাত্ব স্বীকার করিলেন তখন মায়ের সোনার সংসারকে পূর্ণরূপে দেখিতে পাইলাম। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া এই পার্বতী উমার প্রেমময়ী পত্নীত্ব এবং অনন্ত-স্নেহময়ী মাতৃত্বের রূপই প্রাধান্য লাভ করিয়া আসিয়াছে; শিবের সহিত প্রণয়-কলহ বা গৃহকলহ ব্যতীত মায়ের ভ্রুকুটিকুটিল মুখ কখনো বড় একটা দেখা যায় নাই-অস্ত্র-শস্ত্র ধারণ তো দূরের কথা। কিন্তু মহাদেবী যখনই ভয়ঙ্করী-রণোন্মাদিণী-অসুরনাশিনী-তখনই তিনি দুর্গা, চণ্ডী, কালী। মায়ের এই অসুরনাশিনী মূর্তির সহিত সর্বাপেক্ষা অধিক যুক্ত হইল মায়ের চণ্ডী-রূপ। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, দেবীর এই অসুরনাশিনী চণ্ডী বা চণ্ডিকার ধারা মায়ের পার্বতী উমার ধারা হইতে একটি পৃথক ধারা। পরবর্তী কালে দুই ধারা নির্বিশেষে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে।’ (দেবীর বিচিত্র ইতিহাস: ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, শশিভূষণ দাশগুপ্ত)
বাঙালির শারদীয়া দেবী দুর্গার সঙ্গে বাংলার মেয়েদের বছরান্তে পিতৃগৃহে আসার আবেগটি নিপুণভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই দুর্গা ভয়াল-করাল হন্ত্রী দেবতা নন। উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রচলিত নবরাত্রের সঙ্গে চিহ্নিত যুদ্ধ দেবী বা তান্ত্রিক মতের শক্তিস্বরূপা কোনো দেবীও নন। তিনি 'ব্রহ্মরূপসনাতনী কাত্যায়নী'র মতো বিপুল গরিমাও প্রদর্শন করেন না। যদিও এই দুর্গা দেবীর পূজা প্রকরণের মধ্যে পুরাণ ও তন্ত্রমতের ব্যাপক প্রভাব চোখে পড়ে। পুরোহিততন্ত্রের অধিকার প্রমত্ত আচার-আচরণও যথেষ্ট প্রকট। কিন্তু বাঙালিদের জন্য সেসব 'শাস্ত্রীয়' লোকাচারের আবেদন বিশেষ তাৎপর্য রাখে না। তাঁরা দেবী দুর্গার শারদীয় যাত্রাটিকে মেয়ের বাড়ি ফেরা হিসেবে দেখতেই ভালোবাসেন। সে জন্য দেবীপক্ষের শুরু থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়টি বাঙালির জন্য প্রকৃতপক্ষে ‘দেবীপক্ষ’ নয়। তাকে 'কন্যাপক্ষ' বলাটাই হয়তো সমীচীন।
বাংলার সাধারণ মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন। কখন কন্যারূপী দুর্গার আগমনে চিরাচরিত দুঃখময় জীবনে আনন্দের ফুল্ল মুহূর্তগুলো জেগে উঠবে। দেবীর রূপের এই বিবর্তন একান্তভাবেই বঙ্গীয় পারিবারিক লোকবিশ্বাসের অঙ্গ। শরৎকালীন এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে বাঙালি শিল্পীরা একটি বিশেষ ধারার সংগীত পরম্পরাও সৃজন করেছিলেন। অন্যান্য শিল্পমাধ্যমেও দেবী দুর্গার দুহিতারূপী সত্তাটিকে গরিমান্বিত করার প্রয়াস পাওয়া হয়েছে।
সমাজের পারিবারিক এককগুলো ছিল পুরাণযুগ এবং পরবর্তীকালের আর্য সভ্যতার ভিত্তি। পারিবারিক মূল্যবোধের ছাঁচ ছিল একান্তভাবে পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল। তারা তৈরি হয়েছিল ‘সমাজবন্ধন’ নামক একটি বিমূর্ত তাড়না থেকে। বৈদিক যুগ থেকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে পৌঁছে যাওয়ার পর এই বাঁধাবাঁধি তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। ক্রমেই পারিবারিক রক্ষণশীলতার চাপ একক মানুষের আত্মপরিচয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার প্রভাবে আমাদের ব্যক্তিগত আত্মবিশ্বাস চূর্ণ হয়ে যায়। এ জন্যই ভারতীয় সভ্যতার দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা সৌধ, বহিরাগতদের সামান্য আক্রমণে বালুর প্রাসাদের মতো ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল।
পারিবারিক রক্ষণশীল 'পবিত্রতা'র দায় পালন করতে গিয়ে ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থা দৈবী চরিত্রদের সাহায্য নিত। বিভিন্ন আখ্যানে নানা রকম দেবতাদের পাত্রপাত্রী করে গল্প বাঁধার কৌশল নেওয়াটাই স্বাভাবিক পদ্ধতি ছিল তখন। এই রকম একটা সময়ে পুরাণকারেরা ত্রিকালপতি, দেবাদিদেব মহাদেবকেও মানুষি সংসারবন্ধনে বেঁধে ফেলেছিলেন। তাঁকে মানুষের পারিবারিক যাপনের অনুকরণে দৈনন্দিন ধুলো খেলার শরিক করে ফেলা হয়। পুরাণ যুগ থেকেই সতী বা উমা এবং পার্বতীর সঙ্গে শিবের একটা সাংসারিক বন্ধনের উপাখ্যান প্রচলিত ছিল। নানা কাব্যকাহিনির মাধ্যমে তার প্রচার ছিল অব্যাহত। যদিও শিবের অবস্থান বিশেষ বদলায়নি। কিন্তু নানা কারণে পার্বতীর রূপ পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। এই সব রূপের মধ্যে প্রধান 'মহিষমর্দিনী' অবতার। অন্য রূপগুলো নানা তন্ত্রোক্ত শক্তি দেবীর নামে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছিল।
দেবীর রূপগত বিবর্তনের নানা ধারা সমান্তরাল চলে এসেছে হাজার দুয়েক বছর। এদের মধ্যে তাঁর হিমালয় দুহিতা হিসেবে সতী, উমা বা পার্বতী রূপটির চিরন্তন লোকপ্রিয়তা আছে। গুপ্ত যুগের অনেক আগে থেকেই শিবের এই সাংসারিক গার্হস্থ্য যাপনটি নিয়ে লোকের আগ্রহ চোখে পড়ে। কালিদাসের 'কুমারসম্ভব' আবহমান ধারণাটিরই কাব্যিক প্রকাশ। দুই পুত্র নিয়ে ভার্যাসহ কৈলাসে শিবের সংসার নির্বাহ, এ দেশের সাধারণ মানুষের সাইকির মধ্যে গভীরভাবেই প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল।
পার্বতী ক্রমাগত রূপ পরিবর্তিত হয়ে কখনো 'মহাদেবী' হয়ে গেছেন; কখনো বা 'আদ্যাশক্তি' অথবা সুপরিচিত মহিষমর্দিনী। এই পরম্পরাটিকেই আধ্যাত্মিক চিন্তায় প্রাথমিকতা দেওয়া হয়েছিল। তা সত্ত্বেও 'কন্যা' উমা বা 'জামাতা' মহেশ্বরের ইমেজ কখনো ম্লান হয়নি। অধিকন্তু, সময়ের সঙ্গে তাতে নানা নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে।
বৈদিককালে দেবী সরস্বতী স্বাধীনা ছিলেন। পুরাণ যুগে তিনি ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। নানারূপে দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে বিষ্ণুর যোগাযোগও আদিকাল থেকেই রয়েছে। কিন্তু সম্ভবত ভাগবত পুরাণের কালে এসে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুজনেই 'আদ্যাশক্তি' বা পার্বতীর অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। মোটামুটিভাবে ষোড়শ শতক থেকে পূর্ব ভারতে এই দুই দেবী ব্রহ্মা বা বিষ্ণুর পুরোনো ‘আশ্রয়’ ছেড়ে শিবের সংসারের সঙ্গে পাকাপাকিভাবে যুক্ত হয়ে যান।
মধ্যযুগে বাংলা, অসম ও ওড়িশা অঞ্চল পিতৃতান্ত্রিক, ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থায় ওতপ্রোত ছিল। তার সঙ্গে এই সব দেশে কৌম শাক্ত সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চাও চোখে পড়ে। ফলে এখানে সমাজ জীবনে যথেষ্ট পরিমাণে মাতৃতান্ত্রিক ঝোঁক দেখা যেত। দেবী দুর্গার ভগবতী রূপ ব্রাহ্মণ্য মতে মহাদেবীর পালনকর্ত্রী ভাবমূর্তির প্রতীক। যৌথ পরিবারের গৃহলক্ষ্মী হিসেবে দেশের এ প্রান্তে সেই রূপটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। সপ্ত মাতৃকা বা চৌষট্টি যোগিনী পরিবৃতা চামুণ্ডা বা ছিন্নমস্তারূপ যুদ্ধ দেবী ক্রমে হয়ে গেলেন স্নেহময়ী, সন্তাননিষ্ঠ মাতা। মাতা এবং তাঁর সন্ততিরাই দ্রুত পাদপ্রদীপের আলোটি আত্মসাৎ করে নিলেন। 'গৃহকর্তা' শিব সেখানে উপলক্ষ মাত্র।
সাবেকি ভূমিনির্ভর কৃষি অর্থনীতির শর্ত পূরণ করতে ভারতবর্ষ একদিন যৌথ পরিবারব্যবস্থাকে আশ্রয় করেছিল। তার ফলে উমা, হৈমবতী, পার্বতী ইত্যাদি চরিত্র মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি শারদীয় দেবী দুর্গা বাঙালির কাছে নতুন ভাবমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। এই দেবীর আনুকূল্যে যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থাটি সংখ্যাগুরু মানুষের আনুগত্য লাভ করে। অষ্টম-নবম শতক নাগাদ সংকলিত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গণেশ জননী ও শিবের প্রিয়তমা পত্নী দুর্গাকেই সর্বজন আরাধ্যা পূর্ণব্রহ্মসনাতনী বলা হয়েছিল। দুর্গার এই রূপের সঙ্গে মার্কণ্ডেয়পুরাণ, দেবীপুরাণ বা দেবী মাহাত্ম্যে বর্ণিত ভয়ংকরী মহিষমর্দিনী রূপের কোনো সম্পর্ক নেই।
সময়ের সঙ্গে পণ্ডিতদের এত মাতামাতি তুচ্ছ হয়ে গেল। কোনো আরোপিত ধর্মীয় চাপ কাজ করল না। সনাতন আবেগপ্রবণ বাঙালি অপত্যস্নেহের রূপ হয়ে দুর্গা কবির হৃদয়ে পরম স্নেহের দুহিতা রূপেই শাশ্বত স্থান করে নিলেন,
‘...পরাণপুতলি উমা যে আমার
আসি বলে গেল, আসিল না আর
আমি নিবারি কেমনে নয়নের জল
না হেরি আমার নয়নতারারে ।।’
(দাশরথি রায়- আগমনী)