দুর্গাপূজার উৎসভূমি ও রাজা কংসের স্মৃতি
মহাষষ্ঠীর সকাল। তাহেরপুরে তখনো কোনো মণ্ডপের বেদিতে প্রতিমা ওঠেনি। তবে ঢাকের বাড়ি পড়েছে। তালে তালে আট বছরের একটি শিশু নেচেই যাচ্ছে। তার পোশাক-আশাকই বলছে, খুবই সাধারণ ঘরের শিশু সে।
ত্রেতাযুগে স্বয়ং ভগবান রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য অকালে এই পূজা করেছিলেন। আর কলিযুগে রাজা কংস নারায়ণ আধুনিক পদ্ধতিতে উৎসবের ঘনঘটায় এই পূজার আয়োজন করেন। মহাযজ্ঞের মাত্রা ছাড়িয়ে তা আজ সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। আজও চলছে সেই ধারা।
তাহিরপুর রাজবংশ বাংলাদেশের প্রাচীন রাজবংশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে জায়গাটি রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার একটি পৌরসভা। তবে কালক্রমে ‘তাহিরপুর’ নামটি তাহেরপুর বলে উচ্চারিত হচ্ছে। এই রাজবংশের আদিপুরুষ ছিলেন মৌনভট্ট। আর বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামন্ত রাজা ছিলেন ইতিহাসখ্যাত কংস নারায়ণ রায়। তিনি সুলতানি আমলে চট্টগ্রামে মগ দমনে বীরের ভূমিকা পালন করেন। পাঠান আমলে কিছুদিন ফৌজদারের দায়িত্বও পালন করেন। মোগল আমলে এসে কিছুকাল বাংলা-বিহারের অস্থায়ী দেওয়ান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তিনি ‘রাজা’ উপাধি পান।
বাংলা মোগলদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলে সম্রাট আকবর রাজা কংস নারায়ণকে সুবেবাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। কিন্তু যথেষ্ট বয়স হওয়ায় তিনি দেওয়ানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তাহেরপুরে ফিরে ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
সমসাময়িক বাংলার হিন্দু সমাজে তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকার মানসে এক মহাযজ্ঞ সাধন করতে আগ্রহী হলেন। এই লক্ষ্যে তাঁর পরগণার সব শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দরবারে আহ্বান করে তাঁদের মত চাইলেন।
তাঁর মনোবাসনার কথা শুনে পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী বললেন, ‘বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ—এই চারটি মহাযজ্ঞ নামে কথিত। প্রথম দুটি কেবল সার্বভৌম সম্রাটেরা করতে পারেন আর পরের দুটি কলিতে নিষিদ্ধ। তোমার পক্ষে দুর্গোৎসব ভিন্ন অন্য কোনো মহাযজ্ঞ উপযুক্ত নাই। এই যজ্ঞ সকল যুগে সকল জাতীয় লোকেই করতে পারে এবং এক যজ্ঞেই সব যজ্ঞের ফল লাভ হয়।’ সমাগত সব পণ্ডিত রমেশ শান্ত্রীর এই মতে সমর্থন দিলেন।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে রাজা কংস নারায়ণ সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রবর্তন করলেন। উৎসবটি হয়েছিল বারনই নদের পূর্ব তীরে রামরামা গ্রামের দুর্গামন্দিরে। আজও বাঙালির সর্বজনীন দুর্গোৎসবে সেই পদ্ধতিই অনুসৃত হচ্ছে।
তবে কংস নারায়ণের পরবর্তী চতুর্থ পুরুষ লক্ষ্মী নারায়ণের সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছোট ভাই বাংলার সুবেদার শাহ সুজা বারনই নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত রাজা কংসের প্রাসাদ ধ্বংস করে দিয়ে যান।
পরে অবশ্য লক্ষ্মী নারায়ণ আওরঙ্গজেবের অনুকম্পায় নদীর পশ্চিম তীরে একটি পরগনা লাভ করেন। সেখানেই রাজবাড়ি নির্মাণ করে রাজত্ব করেন। ১৮৬২ সালে রাজা বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী রানী জয় সুন্দরী রাজবাড়ির সঙ্গে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের নামফলকটি বর্তমানে রাজশাহীতে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন শিবশেখরেশ্বর। তাঁর বাবা শশী শেখরেশ্বরের সময় থেকে রাজারা কলকাতায় গিয়ে থাকতেন। শুধু পূজার সময় আসতেন। ১৯২৭ সালে শেষবারের মতো তিনি তাহেরপুরে এসেছিলেন। এরপর তিনি মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়।
একপর্যায়ে রাজবাড়ির এই মন্দিরটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে রাজবাড়িতে কলেজ করা হয়। রাজবাড়ির ভেতর থেকে মন্দিরে যাওয়ার ফটকটিও একসময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। মন্দিরটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে যায়।
মন্দির কমিটির সভাপতি নিশিত কুমার সাহা জানান, গত তিন বছর থেকে তাঁরা নতুন করে এই মন্দিরটিতে দুর্গাপূজা শুরু করেছেন। গত বছর জরাজীর্ণ মন্দিরটির ছাদটি সংস্কার করেছেন। দেয়ালে টাইলস লাগিয়েছেন।
গত সোমবার মহাষষ্ঠীর সকালে আধুনিক দুর্গোৎসবের উৎসভূমি তাহেরপুরে গিয়ে দেখা গেল, নদীর পূর্ব তীরে সেই রামরামা গ্রামে সম্প্রতি একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে পূজার আয়োজন চলছে। তবে নদীর পশ্চিম তীরে হচ্ছে আসল উৎসব। সেখানে ১০টি মণ্ডপে চলছে পূজার আয়োজন।
তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের ভেতর গিয়ে দেখা গেল ঐতিহাসিক মন্দিরটির ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ফটকের কাঠামো এখনো রয়েছে। স্থানীয় এক যুবক বললেন, তাঁরা দেখেছেন এই ফটকের ওপরে একটি গড়ুল পাখি ও দুটি মানুষের মূর্তি ছিল।
রাজবংশের কেউ আর এই এলাকায় থাকেন কি না, খোঁজ নিতে গেলে কলেজের শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, রাজা কংস নারায়ণের বংশের কেউ নেই। পরবর্তী রাজারা কংসের উত্তরাধিকার ছিলেন না। তাঁদেরও কেউ এখানে থাকেন না।
তবে কলেজেই শেষ রাজার ম্যানেজারের নাতিকে পাওয়া গেল। তাঁর নাম সত্যজিৎ রায়। তিনি ওই কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। তিনি বলেন, তাঁর দাদা রসিক কুমার রায় শেষ রাজার ম্যানেজার ছিলেন।
রাজবাড়ির মন্দিরের কাছে গিয়ে দেখা যায়, তাহেরপুর পৌরসভার প্রয়াত মেয়র আলো খোন্দাকারের ‘মা দুর্গার সাধারণ্যে আবির্ভাবস্থল’ শিরোনামে উন্মোচন করা একটি ফলক। মন্দিরের ভেতরে গিয়ে পাওয়া গেল মন্দির কমিটির সেক্রেটারি কার্তিক সাহাকে। তিনি বললেন, এটিই তাহেরপুরের প্রাচীন মন্দির। আর তাহেরপুর থেকেই যেহেতু দুর্গোৎসবের শুরু, তাই তাঁদের দাবি, এই মন্দিরটিকে জাতীয় মন্দির ঘোষণা করা হোক আর তাহেরপুরকে তীর্থস্থান ঘোষণা করা হোক।
নদীর পূর্বতীরে রাজা কংসের প্রাসাদের কিছু অবশেষ এখনো রয়েছে। নদীর ধার দিয়ে আশির দশকেও পাহাড়ের মতো উঁচু মাটির দেওয়াল ছিল। এর ভেতরেই ছিল রাজা কংসের প্রাসাদ। তিন কিলোমিটার পথ হাঁটতে গিয়ে পায়ের নিচে প্রাসাদের ছোট ইট আর ইট। পাওয়া গেল আওরঙ্গজেবের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত আওরঙ্গবাদ নামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর একটি লক্ষ্মী মন্দির। মন্দিরের তত্বাবধায়ক নির্মল চন্দ্র মহন্তের দাবি, মন্দিরটি ৬০০ বছর আগের।