তত্ত্বে ও তথ্যে দুর্গাপূজা
বেদান্তে সংক্ষেপে বলা হয়, সকল মানুষের লক্ষ্য সকল দুঃখের চিরতরে বিনাশ এবং পরম আনন্দ পাওয়া। নিরাকার পরমেশ্বর এক হয়েও তাঁর মহামায়া শক্তিকে অবলম্বন করে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় ক্রিয়ায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর নাম-রূপ ধারণ করেন।
শক্তি ছাড়া ক্রিয়া সম্ভব নয়। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে আছে: এই মহামায়াই বিষ্ণুর পালনী শক্তি বৈষ্ণবী, শিবের ধ্বংস শক্তি শিবানী এবং ব্রহ্মার সৃষ্টি শক্তি ব্রহ্মানী। মহামায়ার শরণাপন্ন হলে সকলের দুঃখ তিনি দূর করেন। ভক্তরা প্রার্থনা করেন: হে মা, তুমি আমাদের পূজা গ্রহণ করো। আমাদের আয়ু, আরোগ্য, ধন দাও। মাটির প্রতিমায় এবং বিল্ববৃক্ষ আবাহন করছি। অচঞ্চলা লক্ষ্মী হয়ে আমাদের ঘরে অবস্থান করে ইচ্ছা পূরণ করো।
প্রত্যেক ধর্মেরই তিনটি দিক আছে। সেগুলো হলো: দর্শন, পুরান ও অনুষ্ঠান। দর্শন হলো তত্ত্ব বা রহস্য। সেই রহস্যকে পৌরাণিক কাহিনির মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়। আর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দর্শন বা তত্ত্ব পায় ব্যবহারিক রূপ। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে আছে—স্বর্গ দেবতাদের ভোগের জায়গা। পুণ্য কর্ম করে দেবতারা স্বর্গরাজ্য পেয়েছেন। যুদ্ধে দেবতাদের হটিয়ে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে নিল মহিষাসুর। দেবতারাও অসহায় হয়ে মানুষের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দেবতারা ব্রহ্মাকে জানালেন দুঃখের কথা। ব্রহ্মা দেবতাদের নিয়ে শিব ও বিষ্ণুর কাছে গেলেন। দেবগণ মহিষাসুরের দৌরাত্ম্য ও তাদের পরাজয়ের কাহিনি বর্ণনা করলেন শিব ও বিষ্ণুর কাছে: সূর্য, ইন্দ্র, বায়ু, যম, বরুণ ও অন্যান্য দেবতাদের সুখভোগ করার অধিকার মহিষাসুর হরণ করেছে। শুনে বিষ্ণু ও শিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও শিবের বদন থেকে এবং পরে অন্য দেবগণের শরীর থেকে বিপুল তেজ নির্গত হয়ে এক নারীর দেহে রূপান্তরিত হলো। এই শরীর অবলম্বন করে জগজ্জননী মহামায়া দুর্গতিনাশিনী দুর্গারূপে আবির্ভূত হলেন।
নিজেদের অস্ত্র থেকে বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে দেবীকে সকলে সাজালেন। গিরিরাজ হিমালয় দিলেন তাঁর বাহন সিংহ। এই দেবী সকল অসুর অনুচরসহ মহিষাসুরকে বধ করে দেবতাদের স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিলেন।
প্রাচীনকালে নন্দরাজার গৃহে যশোদার গর্ভে তিনি জন্মগ্রহণ করে বিন্ধ্য পর্বতে অবস্থান করে শুম্ভ ও নিশুম্ভকে হত্যা করার সংকল্পও করেছিলেন।
জগজ্জননী মহামায়া দুর্গাই বিভিন্ন রূপ ধরে রয়েছেন। শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে বর্ণনা আছে, সকলের মাঝে তিনি মা হয়ে, সমস্ত প্রাণীর ক্ষুধা হয়ে, পুণ্যবানের ঘরে লক্ষ্মী হয়ে, আর পাপীদের ঘরে অলক্ষ্মী হয়ে আছেন। মানুষ মাত্রই ভুল করে, এই ভ্রান্তিরূপেও তিনি সকলের মধ্যে রয়েছেন। শাক মানে শস্য। সেই শস্য হয়ে তিনিই আছেন পৃথিবীতে। এ জন্য তাঁর এক নাম ‘শাকম্ভরী’। শস্যসম্পদ হয়ে আমাদের ÿক্ষুধা নিবারণ করে আমাদের ক্ষুধারূপ দুর্গতি নাশ করে হয়েছেন দুর্গা। এ জন্যই দুর্গাপূজায় নয়টি শস্য দিয়ে তৈরি হয় দুর্গা দেবীর আর এক রূপ ‘নবপত্রিকা’। মায়ের স্বরূপ অনুভব করেন ঋষিগণ ধ্যানে। সেই ধ্যান অনুসারেই প্রতিমা তৈরি হয়। বাবার ফটোগ্রাফ দেখলে যেমন বাবাকেই মনে পড়ে, সে রকম প্রতিমা দেখলে তাঁকেই মনে পড়বে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, গৃহস্থের ভক্তি আর প্রতিমা সুন্দর হলে এবং পূজারির ভক্তি থাকলেই প্রতিমায় তাঁর আবির্ভাব হয়। ভক্তিতেই ভক্তগণ মায়ের মহিমা অনুভব করে থাকেন।
সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মাও মহামায়ার স্তব করেছিলেন: ‘আপনি বেদের মাতা গায়ত্রীরূপা, দেবগণের আদি মাতা। আপনি এই জগৎ ধারণ করে রয়েছেন, আপনি জগদ্ধাত্রী। আপনিই সৃষ্টিশক্তি, পালনশক্তি ও সংহার শক্তিরূপে বিরাজ করেন। আপনার স্তব কে করতে পারে! আপনি কৃপা করে বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগিয়ে এবং তাঁর মনে অসুর মধু ও কৈটভকে সংহার করতে ইচ্ছা জাগিয়ে তুলুন।’ মহামায়া তা–ই করলেন। বিষ্ণু মধু ও কৈটভকে বধ করলেন। সৃষ্টি রক্ষা হলো।
গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, ‘সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের মায়ায় আমি আবৃত থাকি বলে সকলের কাছে প্রকাশিত হই না। কেবল কোনো কোনো ভক্তের কাছে আমি প্রকাশিত হই। তাই এই মোহে অন্ধ জগতের মানুষ জন্ম-মৃত্যুশূন্য আমার স্বরূপ জানতে পারে না (গীতা-৭ / ২৫)।’ উপমায় বলা হয়েছে, সামনে রাম পরমাত্মা, পেছনে লক্ষ্মণ জীবাত্মা, আর মাঝে মহামায়া সীতা। সীতা একটু সরে না গেলে লক্ষ্মণ রূপ জীব রামরূপ পরমাত্মাকে দেখতে পায় না। ভগবান যে মায়ার কথা বলেছেন, তার স্বরূপ ও প্রভাব জানতে পারলে আমরা তাঁকে প্রসন্ন করে মুক্ত হতে পারি, মহামায়ার কৃপায় ঈশ্বর লাভ করে মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারি।
দুর্গাপূজায় দেবীর প্রণাম মন্ত্রে বলা হয়: ‘জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।/ দুর্গা শিবা মা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোস্তুতে।’ তিনি সর্বোৎকৃষ্টা বলে তাঁকে বলা হয় ‘জয়ন্তী’। তিনি জন্ম-মৃত্যু বিনাশিনী, তাই তিনি ‘মঙ্গলা’। প্রলয়কালে সমগ্র জগৎকে গ্রাস করেন বলে তিনি ‘কালী’। তিনিই সুখদান করেন, এ জন্য ‘ভদ্রকালী’। সৃষ্টির কারণকে রক্ষা করেন বলে তিনি ‘কপালিনী’। অনেক দুঃখেই তাঁকে পাওয়া যায়, এ জন্য তিনি ‘দুর্গা’। তিনি চৈত্যস্বরূপিণী, তাই ‘শিবা’, করুণাময়ী বলে তাঁর নাম ‘মা’, বিশ্ব ধারণ করে থাকেন বলে ‘ধাত্রী’, দেবগণের পোষণকারিণী বলে তিনি ‘স্বাহা’ এবং পিতৃলোক পোষণকারিণী বলে তিনি ‘স্বধা’। চরাচরের সর্বত্রই তিনি।
দুর্গাপূজার ঐতিহ্যও আছে। রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধনা করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়ের জন্যে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন দুর্গার স্তব করলেন: ‘নমস্তে বিশ্বসেনানী আর্যে মন্দারবাসিনি...’ ইত্যাদি। মার্কন্ডেয় মুনির পরামর্শে এই পূজা করেই সুরথ রাজা তাঁর রাজ্য ফিরে পেলেন। আবার সমাধি বৈশ্য সমস্ত মোহ ও মমতার সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হলেন। এটাও ঐতিহ্য। প্রাচীনকালে যেমন সত্য ছিল, বর্তমান কালেও তাই। বর্তমানেও মানুষ ধন-পুত্র, যশ, রূপ, জয় ইত্যাদি লাভের জন্য দুর্গাপূজা করে থাকেন। ভক্তি ও মুক্তিলাভের জন্যও করেন। দুর্গাপূজায় ভক্ত অনুভব করেন, আমরা সকলে একই মায়ের সন্তান। সকলেই আমরা আপন। সকলের মধ্যে সম্প্রীতি দুর্গাপূজার এক বিশেষ দিক।
আমরাও দুর্গা দেবীকে প্রণাম জানাই। হে দেবী, আপনি সকলের হৃদয়ে বুদ্ধিরূপে বিরাজ করেন। আপনিই নারায়ণী, স্বর্গ বা ভোগ এবং অপবর্গ বা মুক্তি দান করেন। আপনি সকল মঙ্গলস্বরূপা, সকল আকাঙ্ক্ষা পূরণকারিণী, একমাত্র আশ্রয়রূপা, সূর্য-চন্দ্র-অগ্নি আপনার তিন নয়ন, আপনি গৌরীবর্ণা। আপনাকে প্রণাম।
স্বামী স্থিরাত্মানন্দ: সম্পাদক, শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম, চাঁদপুর।