চৈত্র সংক্রান্তির বেসমা উৎসব
চৈত্র মাসের শেষ দিনটি যেমন মাসের শেষ দিন তেমনি বছরেরও শেষ দিন। সাধারণ ভাবে বাংলা শেষ মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় সংক্রান্তি। এক অর্থে সংক্রান্তি ধারণাটি এমন যে কালের আবর্তে অসীমের মাঝে সাঁতরে, সূর্য এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে (মীন রাশিতে প্রবেশ করে) গমন করে। ছুটে চলে সময়, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর অবিরাম চলে ক্রান্তির সঞ্চারে। অর্থাৎ এক ক্রান্তি বা প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত বা ক্রান্তিতে যায়। এ দিনকে সূর্য সংক্রান্তি বলা হয়।
পৌরাণিক সূত্রে জানা যায়, দক্ষ রাজার সাত কন্যার বিয়ে হয় চন্দ্রদেবের সঙ্গে। সেই সাতজন কন্যার একজন চিত্রা। তার নাম অনুসারে চিত্রা নক্ষত্র এবং চিত্রা নক্ষত্রের নাম থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে বাঙালিরা চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে পালন করেন। এখনো এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের মতো পালন করেন চৈত্রসংক্রান্তির দিনটি। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যজনক মনে করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে নানা অনুষ্ঠান-পূজা-পার্বণ-মেলা। এটি একটি লোক উত্সব। চৈত্র সংক্রান্তির এ দিনটিকে ‘বেসমা’র দিনও বলা হয়।
বেসমা উত্তরবঙ্গের চৈত্র সংক্রান্তির পার্বণ। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা এ পার্বণ পালন করেন। বৈশাখ বরণ বা আগমনী অনুষ্ঠানও বলা হয় একে। এই দিন সকাল থেকে ঘর-বাড়ি, ব্যবহৃত কাপড়, বাসন কোসন পরিষ্কার করা হয়। রান্না ঘরে ব্যবহৃত ‘নাকরী’ (ডাল/তরকারী মিশ্রণের পাটকাঠি ও বাঁশের তৈরি নাড়নকাঠি) পুরোনো ঝাড়ু ফেলে দেওয়া হয়। এই দিন নদী/খাল থেকে মাটি নিয়ে এসে ঘর-বাড়ি ও তুলসী তলা লেপা হয়। এ মাটিকে বিষ মাটি বলে।
পরিবারের নারী সদস্যরা নিকোনো বাড়িতে ফুল-লতা-পাতার আলপনা আঁকেন। দুপুর বেলা একজন ব্যক্তি ধারালো অস্ত্র নিয়ে যে সকল গাছে ফল হয় না কিংবা কম ফলন হয় সে সব গাছ কাটতে যান। পেছন থেকে অন্য একজন ব্যক্তি টেনে ধরে বলেন, ‘না কাটেন বাহে আরবার (পরের বার) মেলা ফল ধইরবে।’ এ অঞ্চলের লোকেরা বিশ্বাস করে এই দিনে গাছকে ভয় দেখালে পরবর্তী সময়ে বেশি ফল ধরে।
চৈত্র সংক্রান্তির গোধূলি লগ্নে বেসমা পূজা করা হয়। পূজার পর্বে ঘরের দরজায় বাগাচূড়া (চ্যাপ্টা পাতা ও কাঁটা যুক্ত বনজ লতা), বিষ ঢেঁকিয়া (ফার্ন), বিষ কুণ্ডলী (বিষকাঁটালী), রসুন, পেঁয়াজ এক সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এগুলো অশুভ শক্তি নাশের প্রতীক বলে বিশ্বাস করে এ অঞ্চলের লোকেরা। আজকাল জনবসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় কমে গেছে বন জঙ্গল ফলে বাগাচূড়া দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।
গম, আস্ত ছোট আলু, তিল, সরিষা, বাদামের সঙ্গে কাঁঠালের মুচি বা কড়া, কচি আম, আদা-হলুদ কুচিকুচি করে নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। বর্তমান সময়ে গমের চাষ কমে যাওয়ায় সিদ্ধ চাল ভেজে নৈবেদ্য হিসেবে নিবেদন করে। সকল দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে বেসমার নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। উত্তরবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিশ্বাস করেন, বেসমার চাল/গম চিবালে দাঁত শক্ত হয়। বেসমার নৈবেদ্য পুঁটলি করে বেঁধে রাখলে ঘরে চড়ক (বজ্রপাত) পড়ে না।
সন্ধ্যা বেলা ঘরের দরজার পাশে ভোগ দেওয়া হয়। এক ফুট পরিমাণ পাটকাঠি ভেঙে তার মাথায় পাট পেঁচিয়ে ঘি মাখিয়ে নেওয়া হয়। পরে একে আগুন ধরিয়ে দরজার পাশে পুঁতে দেওয়া হয়। চৈত্র সংক্রান্তির রাতের বৃষ্টিকে বিষ ঝড়ি বলে। বিষ ঝড়ি হলে সাপ কিংবা বিষাক্ত কীট পতঙ্গের উপদ্রব কমে হয় বলে এ অঞ্চলের লোকেরা বিশ্বাস করেন।
চৈত্র সংক্রান্তির দিন এই অঞ্চলের লোকেরা ষোলো প্রকার শাক খেয়ে থাকেন। এ ছাড়া প্রত্যেকেই একটি তেতো পদ রান্না করেন। যেমন করলা ভাজি বা গিমা শাক। এ ছাড়া বালা তিতা নামের এক প্রকার শাক বেশ জনপ্রিয় এ অঞ্চলে। এ দিন কোথাও কোথাও চড়ক পূজা ছাড়াও অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা ও মেলা বসে। পরের দিন পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে কোথাও কোথাও মেলা বসে।
লেখক: শিক্ষার্থী, নাট্যকলা ও পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়