আমার প্রথম দুর্গোৎসব, শেষের দুর্গাযাপন

দুর্গোৎসব
দুর্গোৎসব

আমার জন্মগাঁয়ের সাত-আট গ্রাম উত্তরে আমার মামাবাড়ি। মায়ের জন্মগ্রামটির নাম উত্তর কাট্টলি। ওই গাঁয়ের জেলেপাড়াটি স্বাভাবিক নিয়মে এবং প্রয়োজনে বঙ্গোপসাগরের গায়ে গায়ে। এ পাড়ার মানুষজন অন্য দশটি জেলেপল্লির মতো দরিদ্র, ভীষণ দরিদ্র। অধিকাংশ জেলের ঘরবাড়ি জীর্ণ। এধার ভাঙা, ওধার জোড়াতালি দেওয়া। ওদের ঘরবাড়ি, জীবনব্যবস্থা জীর্ণ আর নড়বড়ে হলে কী হবে, ও পাড়ার দেবীটি কিন্তু অনেক শানশওকতের মধ্যে পূজিত। দেবী মানে কালী। কালী দুর্গারই ভিন্ন রূপ। দুর্গা দেবী বারো মাসে বারো নামে পূজিত। বৈশাখে গন্ধেশ্বরী নামে, জ্যৈষ্ঠে ফলহারিণী, আষাঢ়ে কামাক্ষা, শ্রাবণে শাকম্ভরী, ভাদ্রে পার্বতী, আশ্বিনে দুর্গা, কার্তিকে জগদ্ধাত্রী, অগ্রহায়ণে কাত্যায়নী, পৌষে পৌষকালী, মাঘে রটন্তীকালী, ফাগুনে সংকটনাশিনী আর চৈত্রে বাসন্তী নামে পূজিত হন। তো উত্তর কাট্টলির জেলেরা দুর্গার মা কালী রূপকে সংবৎসর পূজা করে আসছিল।

মামাবাড়ির পশ্চিম পাশঘেঁষা ছোট্ট একটি খাল বয়ে গেছে। ওই খালের পশ্চিম পাশ ছুঁয়েই একটা কালীমন্দির তৈরি করেছে ও পাড়ার জেলেরা। কী করে করে যেন কালীমন্দিরটি পাকাও করে ফেলেছে তারা। নিজেদের ঘরদোর কাঁচা হলে কী হবে, দেবী মন্দিরটি পাকা করতে কোনো কার্পণ্য দেখায়নি তারা। মাধুকরীবৃত্তি অবলম্বন করে, এর–ওর কাছে হাত পেতে, ইলেকশনের আগমুহূর্তে ভোটপ্রার্থী চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে দাবিদাওয়া দিয়ে মন্দিরটিকে দেখার মতো রূপ দিতে পেরেছে উত্তর কাট্টলির জেলেপাড়ার মানুষগুলো। ওই মন্দিরে স্থায়ী কালীমূর্তি—পাথুরে, ভীষণাকৃতি, ভয়–জাগানিয়া। তাঁর দুপাশে দাঁড়ানো চেলা-চামুণ্ডাদের চেহারা-আকার ত্রাস সৃষ্টিকারী।

ওই কালীমন্দিরের সামনে দিয়েই মামাবাড়িতে ঢুকতে হতো আমাদের। মামাবাড়ি ঢোকার আগে মা তার আধা ডজন সন্তান নিয়ে কালীমন্দিরে ঢুকত। মা বলত, প্রণাম করো, প্রণাম করো, উপুড় হয়ে প্রণাম করো।

অন্য ভাইবোনেরা দিব্যি এপাশ–ওপাশ তাকাতে তাকাতে, মা কালীর জিহ্বা ও পরিধেয় রক্তাক্ত নরহস্তের বর্ণনা দিতে দিতে, কালীহস্তে ধৃত রক্তরঞ্জিত নরমুণ্ডকে গভীরভাবে অবলোকন করতে করতে হেসেখেলে মা কালীর চরণে প্রণাম জানাত। কিন্তু মা কালীতে ভীষণ ভয় ছিল আমার। চোখ বন্ধ করে টিপ করে প্রণাম সেরে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতাম আমি।

এই কালীমন্দিরের চত্বরে এক বছর শারদোৎসবের আয়োজন করল মামাবাড়ির লোকেরা। আমার বয়স তখন বারো-তেরো। আমার জন্মগ্রাম উত্তর পতেঙ্গায় দুর্গাপূজা হতো না। নিজের বাপের পাড়ায় প্রথম দুর্গাপূজার খবর পেয়ে মায়ের আনন্দের সীমা থাকল না। পূজা শুরুর এক দিন আগে মা তার এক–দুজন সন্তানকে স্বামীর কাছে রেখে আর দু-চারজনকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়িতে গেল। সেবার ওই কালীমন্দির চত্বরে ঢুকতে গিয়ে ভয়ে আমার বুক কাঁপেনি। ঢুকেই দুর্গার মুখোমুখি হয়েছি আমি। শান্ত-সৌম্য, অভয় প্রদানকারী মুখ দুর্গা দেবীর। দুদিকে দাঁড়ানো তাঁর চারটি সন্তান। একজন ছাড়া অন্য সব সন্তানই দৃষ্টিনন্দন। গণেশঠাকুরের মুখমণ্ডল প্রশ্ন-জাগানিয়া। হস্তীমুখো মোটা পেটের গণেশই সেই সময়ে বালক হরিশংকরকে বেশি আকর্ষণ করেছিলেন। গণেশের চেহারা নিয়ে বাবা-মা এবং অন্যরা নানা রকম পৌরাণিক কথাবার্তা শুনিয়েছিল আমাকে সেই বয়সে। পরবর্তীকালে বুঝেছি, পশুত্ব আর মানবতার সমন্বয় করার জন্যই পুরাকালে গণেশের এই ধরনের মূর্তির কল্পনা করা হয়েছে। মানুষ যে আসলেই পুশুত্বমুক্ত নয়, তারই দৃষ্টান্ত হিসেবে গণেশের এই রকম রূপ কল্পনা করেছেন শাস্ত্রকারেরা।

সেবার মা বলেছিল, ‘তুমি যে কালী মাকে দেখে ভয় পাও, এই দুর্গা কিন্তু তাঁরই ভিন্ন রূপ। আসলে দুজনেই একজন।’

আমি বলেছিলাম, তা কী করে হয় মা। মা কালীর পায়ের নিচে দেখো তাঁর স্বামী পিষ্ঠ হচ্ছেন। হিংস্র চেহারা মা কালীর। আর দুর্গার কী সৌম্য চেহারা। স্বামীটি তাঁর মাথার ওপরে, পায়ের তলায় নয়। দুর্গা আর কালী একজন হন কী করে। ওই বয়সে মাকে আমি এভাবে গুছিয়ে বলতে পারিনি। কিন্তু যা বলতে চেয়েছিলাম, এ রকমই।

আনপড় মা আমার যুক্তি দিয়ে তেমন করে সেদিন বোঝাতে পারেনি যে আসলে কালী আর দুর্গা এক দেবীর দুটো রূপ। দুজনেই অসুর শ্রেণিকে নিধনে উদ্যত। দুজনেরই আবির্ভাব মানবতার সংকটকালে। রূপ ভিন্ন হলে কী হবে, দুজনের উদ্দেশ্য একটাই—পৃথিবীকে পাপাচারমুক্ত করা। বড় হয়ে আমি এসব কথা ভেবেছি।

বাল্যবয়সের সেই উন্মেষকালে আমি দুর্গাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও দুর্গাকে বড় ভালোবাসতেন। নইলে কেন তাঁর সৃষ্ট সবচেয়ে আকর্ষণীয় নারী চরিত্রটির নাম হয় দুর্গা! পথের পাঁচালীর দুর্গা কোন পাঠককে ব্যাকুল করেনি?

এই বয়সে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, আমরা মূর্তিপূজা করি কেন? মাটি-খড়-কাঠ-রং দিয়ে তৈরি দুর্গাপ্রতিমার পূজা করার মাহাত্ম্যই–বা কী? কেউ কেউ শাস্ত্রের বড় বড় শ্লোক আওড়ে চর্যাপদীয় ভাষায় আমাকে বোঝাতে চেয়েছেন যে এটাই নিয়ম। শাস্ত্রলিখিত প্রথম এবং সংস্কার অমান্য করার অধিকার কারও নেই।

অন্য কেউ বলেন, পুজোটুজোর কথা বাদ দিয়ে উৎসবের কথাই ভাবো না কেন? দুর্গাপূজা উপলক্ষে চার দিন ধরে কত মানুষেরই আলাপচারিতা! ভেতরের আর চারদিকের কষ্টকে ঝেঁটিয়ে দিয়ে পূজার চারটা দিন মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যময় সুষম জীবন যাপন করে দেখোনি? উৎসব এবং সম্মিলনের মাহাত্ম্যকে বাদ দেবে কেন?

শেষে তাঁদের কথাগুলো আমাকে বেশ টানে। কিন্তু উৎসবে মূর্তিপূজা কেন? ওঁরা আমতা–আমতা করে বলেন, ওটা প্রথা, ওটা সংস্কার—শাস্ত্রলগ্ন ধর্মাশ্রিত সংস্কার।

তাঁদের কথা আমার মনে ধরেনি। আমি বলি, হিন্দুরা আসলে মূর্তিপূজার আড়ালে মৃত্তিকা আর বৃক্ষের পূজা করে। পূজা মানে বন্দনা। বন্দনার ভেতরে সব প্রশংসা লুকিয়ে আছে।

প্রতিমা তৈরিতে মাটি লাগে, খড় ও কাঠ লাগে। মাটি আমাদের জীবন ধারণের সব বস্তু উৎপাদনের আধার। অন্ন আসে ধান থেকে। ধান আর খড় একসূত্রে গাঁথা। কাঠ হয় বৃক্ষ থেকে। মানুষ নয় শুধু, সব প্রাণীর জীবিত থাকার সব উৎপাদন সরবরাহ করে এই মৃত্তিকা, খড় আর বৃক্ষ। হিন্দুরা মূলত দুর্গাসহ নানা দেব–দেবীর মূর্তির প্রতীকে জীবনদায়িনী সঞ্জীবনী উপাদানগুলোরই পূজা মানে বন্দনা মানে প্রশংসা করে থাকে।

শারদোৎসব যখন আসত, বাল্যবয়সে বড় আনন্দ লাগত। নতুন জামাকাপড়, পরিচিত-অপরিচিতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কথোপকথন কতই–না আনন্দের ছিল! যথাপ্রথায় ধূপ-মোমবাতি জ্বালিয়ে বাদ্যবাজনা করে পূজা হচ্ছে, মানুষ উপুড় হয়ে দুর্গা-প্রণাম করছে, অল্প ভিড়ে ঘুরে বেড়াতে কতই-না আনন্দ ছিল তখন।

এখন শারদোৎসবে জৌলুশ বেড়েছে অনেক। প্রাণময়তা বেড়েছে কি? এখন মন্দির চত্বরে চত্বরে তেমন করে ঘুরতে ইচ্ছা করে না। কেন? এই প্রশ্ন তাঁদের কাছেই, যাঁরা এই লেখা এতক্ষণ ধরে পড়লেন।

হরিশংকর জলদাস: সাহিত্যিক।