এ এক মাতৃশক্তির আরাধনা
বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা। মানবিক দৈন্য। স্বার্থপরতায় টালমাটাল বিবেক ও মন। ক্ষমতার দম্ভ আকাশচুম্বী। বাদ পড়েনি বাংলাদেশও। তারপরও প্রকৃতির নিয়মেই ঋতু রং বদলায়।
গ্রীষ্মের পর আসে বর্ষা। বর্ষার পর স্বচ্ছ শরৎ। শিউলি সুঘ্রাণ নিয়ে ফোটে। নদীর কূলে দোল খায় সাদা কাশফুল। ঢ্যাং কুরাকুর ঢ্যাং কুরাকুর বেজে ওঠে দুর্গাপূজার ঢাক। ঢং ঢঙা ঢং ঢং বাজে কাঁসর। পুরোহিতের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় মধুর চণ্ডীপাঠ।
শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে চারপাশ মুখর হয়ে ওঠে। ধূপধুনোয় ভক্তিময় আবেশ ছড়ায় চারপাশে। মহালয়ার দিনে মা আসেন। মা দুর্গা আসেন বাবার বাড়ি, মর্ত্যে। ছেড়ে আসেন স্বামীর বাড়ি কৈলাসধাম; কিন্তু বাবা ভোলানাথ আর ছেলে কার্তিক ও গণেশ, মেয়ে সরস্বতী ও লক্ষ্মীকে ছেড়ে আসেন না। সবাই একসঙ্গে আসেন।
মায়ের আগমনে রংবাহারি হয়ে ওঠে পৃথিবী। ভক্তের মন খুশিতে নেচে ওঠে। আনন্দ–উচ্ছ্বাসের জোয়ার উছলে ওঠে।
ভক্তরা জানেন, মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। বিপদনাশিনী। ভক্তের রোগশোক, বিপদ–আপদ—সবই মা দূর করে দেবেন। হারানো ধনসম্পদ ফিরিয়ে দেবেন।
এই বিশ্বাস ধারণ করেই পূজা হয়ে আসছে রাজা সুরথ ও বণিক সমাধি বৈশ্যর সময় থেকে।
তখন শারদীয় পূজার পরিচিতি ছিল ‘বাসন্তী পূজা’ নামে। দুর্গাপূজার বিধিসম্মত সময়কাল ছিল চৈত্র মাস, অর্থাৎ বসন্তকাল। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রয়েছে, রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য মেধস মুনির পরামর্শে তাঁরই আশ্রমে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে শাস্ত্রবিধিমতে দেবী দুর্গতিনাশিনীর পূজা করেছিলেন।
মনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল তাঁদের। রামচন্দ্র লঙ্কাধিপতি রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে দুর্গা মাকে খুশি করে শক্তি, সাহস, বিজয় ছিনিয়ে আনতে শরৎকালে পূজা করেছিলেন। সেই থেকে শরৎকালেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘দুর্গাপূজা’। তাই কেউ কেউ শারদীয় দুর্গাপূজাকে ‘অকালবোধন’ বলে উল্লেখ করে থাকেন।
জীবনে অশুভ অসুর শক্তির বিনাশ করে শুভ সুর শক্তির প্রতিষ্ঠা দুর্গাপূজার শাশ্বত দর্শন। দেবী মহিষাসুরমর্দিনী এবং সেই কারণেই শিরে শিবধারিণী। মহিষাসুরকে যদি বিনাশ করা যায়, তবে সর্বোপরি শিরে শিবকে, তথা কল্যাণ বা মঙ্গলকে ধারণ করা সম্ভব হয়।
দুর্গাকাঠামোতেও দেখা যায় মহিষাসুর দেবীর পদতলে বিমর্দিত, দেবী রণরঙ্গিণী আর শিব দেবীর মস্তকোপরি অধিষ্ঠিত—এই কাঠামো উন্নত জীবনতত্ত্বের নির্দেশক।
দুর্গাপূজায় ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প; অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। যষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্ব শাখায়।
সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়া বেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়। প্রচলিত ভাষায় একে বলা হয় ‘কলাবউ’।
অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান—অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা ‘সন্ধিপূজা’। অষ্টমী তিথিতে কোনো কুমারী বালিকাকে পূজা করা হয়।
নবমীতে হোম যজ্ঞের দ্বারা পূজার পুণ্যাহুতি দেওয়ার রীতি। দশমী তিথিতে হয় দেবীর বিসর্জন। এই দশমী তিথি ‘বিজয়া দশমী’ নামে খ্যাত।
দেবী দুর্গাই সব শক্তির আধার। নিখিল দেবগণের শক্তিগুলোর ঘনীভূত মূর্তি। মা দুর্গা স্নেহময়ী জননী। তাঁর নয়ন থেকে করুণাধারা সতত বর্ষিত হচ্ছে, ‘মায়ের স্নেহ-চক্ষে প্রেম-বক্ষে অমিয় ঝরে’।
যুদ্ধে যখন তিনি অতি ভীষণা, তখনো তাঁর আঁখি করুণায় ঢল ঢল। ‘চিত্তে কৃপা সমর নিষ্ঠুরতা’—হৃদয়ে মুক্তিপ্রদ কৃপা এবং যুদ্ধে মৃত্যুপ্রদ কঠোরতা, মায়ের মধ্যে এই দুই ভাবের অপূর্ব সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়।
দুর্গাপূজা এক বিশাল দেবযজ্ঞ। এই পূজা সনাতনী সমাজের বৈচিত্র্যকে লালন করছে আপন বক্ষে।
দুর্গাপূজা মানবের এক মহান মিলনমেলা। তিনি যে আমাদের মা। সবাই আমরা তাঁরই সন্তান। মাতৃপূজায় সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যায়। কুমার প্রতিমা, ঘট প্রভৃতি তৈরি করেন। আলোকসজ্জাকারী যাঁরা থাকেন, তাঁরাও তাঁদের কাজ করেন। মালি ফুল দেন, ঢাকি ঢাক বাজান। পূজায় ছানা লাগে, সেটা আসে ঘোষবাড়ি থেকে। নরসুন্দর সম্প্রদায়ের মানুষ দেন দর্পণ।
বর্তমানে বারোয়ারি পূজার যুগ। সবাই চাঁদা দিয়ে অংশগ্রহণ করেন, পুরোহিত পূজা করেন। এমনকি মায়ের পূজায় বেশ্যাদ্বারের মাটি পর্যন্ত দরকার হয়। সহজ কথায়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মাতৃ আরাধনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।
দেবীর চালচিত্রে মাথার ওপর রয়েছেন নির্বিকার ব্রহ্মরূপী শিব। শিবশক্তির মিলনেই এই বিশ্বসংসার ক্রিয়াশীল। অপর দিকে মানবমনে সর্বদা চলে সুরাসুরের যুদ্ধ।
মায়ের কৃপা হলে তিনি ত্রিশূলে বধ করেন মানুষের মধ্যে থাকা অসুর শক্তিকে। সাধন দৃষ্টিতে ত্রিশূলের আঘাতে সত্ত্ব রজঃ তমঃ—এই তিন গুণকে অতিক্রম করে, মানবাত্মার ব্রহ্মচৈতন্যে লয়প্রাপ্তি হয়।
তারাপদ আচার্য্য, তারাপদ আচার্য্য, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ