আমার শারদীয় ছেলেবেলা
আমাদের গ্রামের বাড়ি পদ্মা নদীর একেবারেই পাড়ে। গ্রামের নাম কামার হাট। পাবনা জেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নে। গ্রামের পাশেই নদীর ধার ঘেঁষে একটা মন্দির ছিল। মন্দিরের পাশে একটা জায়গা ছিল, যেখানে দেবীর বিসর্জন দেওয়া হতো।
গ্রামে চার–পাঁচটি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হতো। পরে সব কটি প্রতিমা সেই নদীর ধারের মন্দিরের পাশের জায়গাটায় আনা হতো। সেখানে এক–দুই ঘণ্টা আরতি হতো। সারা গ্রামের মানুষ সেখানে জড়ো হতো। তারপর একসঙ্গে প্রতিমা বিসর্জন হতো।
যখন আমি খুব ছোট, তখন আমার আনন্দ পূজার এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত। যাঁরা প্রতিমা বানাতেন, সেই পালরা এক মাস আগে থেকেই প্রতিমা বানানোর কাজ শুরু করতেন। প্রথম খড় দিয়ে ফিগার বানিয়ে, তারপর একটা বাঁশের কাঠামোয় তা দাঁড় করানো হতো। কয়েকটি ধাপ পার হওয়ার পর ফাইনালি রং দিয়ে প্রতিমার চেহারা দেওয়া হতো। পূজা শুরু হওয়ার আগের দিন সেটি সম্পন্ন হতো।
ওই এক মাস ধরেই আসলে আমার আনন্দ থাকত। পূজার আগে স্কুল ছুটি থাকত। বড় একটা ছুটি পেতাম। আর ছিল নতুন পোশাকের আনন্দ।
আমরা অনেকগুলো ভাই–বোন, সব মিলিয়ে আট ভাই–বোন। বাবা স্কুলশিক্ষক। তাঁর পক্ষে সবাইকে পূজার সময় নতুন পোশাক দেওয়া সম্ভব হতো না।
সে সময় ছিট কাপড় কিনে দরজিবাড়িতে গিয়ে মাপ দিয়ে আসতাম আমরা। প্রতিদিন একবার করে বাজারে গিয়ে দরজির দোকানে খবর নিতাম, জামা-প্যান্ট কত দূর এগোল। কবে কাটা হলো, কবে সেলাই করা হচ্ছে। আপডেটটা প্রতিদিন গিয়ে নিতাম। এ রকম একটা উন্মাদনা ছিল যে নতুন পোশাক পরব। সারা বছরের মধ্যে নতুন পোশাক পরার ওই একটাই সুযোগ ছিল।
কোনো দুর্গাপূজার সময় বাবা হয়তো একটা শার্ট দিলেন। প্যান্টটি হয়তো আমার জন্য বরাদ্দ থাকত না। সব ভাই–বোনকে কিছু কিছু করে দিয়ে ম্যানেজ করা হতো। পোশাকের সেই আনন্দের কথা এখন খুব বেশি মনে পড়ে।
আরেকটি বিষয় ছিল, আমাদের গ্রামে যে পূজা হতো, সেই আনন্দে হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে শামিল হতো। দুর্গাপূজা উপলক্ষে আমাদের গ্রামের বাসিন্দাদের আত্মীয়স্বজন চলে আসত। যে মেয়েটার হয়তো দূরের কোনো জেলায় বা অন্য কোথাও বিয়ে হয়েছে, দুর্গাপূজার সময় সে চলে আসত।
আমাদের তিনটি উৎসব—দুই ঈদ ও দুর্গাপূজার সময় যে আনন্দ হতো বা হয়, সেখানে আমরা কখনো হিন্দু–মুসলিম ভেদাভেদ করিনি। পূজার সময় আমাদের বাড়ির উঠানে বসে আমার মুসলমান বন্ধুরা খাচ্ছে, ঈদের সময় আমরা
তাদের বাড়িতে গিয়ে খাচ্ছি, এটি খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল।
তবে সাম্প্রতিককালে আমি এটি খুব মিস করি। এখন সেই আগের উচ্ছ্বাসে হয়তো কিছুটা ভাটা পড়েছে। তারপরও আমার গ্রামে এখনো সেটা মোটামুটি ঠিকঠাক আছে। ভালো আছে। আমরা ধর্মীয় সম্প্রতি ও সহনশীলতার বিষয়ে এখন যেটি ভাবতে পারি, সেটি কিন্তু আমাদের সেই গ্রাম থেকেই এসেছে। সবার ঊর্ধ্বে মানুষ—এর বাইরে যে চিন্তা করতে পারি না, সেটিও আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য আমাকে শিখিয়েছে।
পূজার সময় মেলা নিয়ে একটা উচ্ছ্বাস কাজ করত। আমাদের পাশের গ্রামে একটা মেলা হতো। দশমীর দিন বিকেলে সেই মেলাটা সেখানে হতো। দূরদূরান্ত থেকে সেখানে লোক আসত। সেই মেলায় আমরাও যেতাম।
সন্ধ্যার সময় মেলা থেকে ফিরে প্রতিমা বিসর্জনে যেতাম। সে মেলায় গিয়ে নানা ধরনের খেলনা ও খাবারদাবার কিনতাম।
ঈদের দিন যেমন ঈদ সালামি বা ঈদি দেওয়া হয়, সে রকম দুর্গাপূজায়ও বড়রা ছোটদের বকশিশ দিত। দশমীর দিন সিনিয়ররা জুনিয়রদের এক টাকা, দুই টাকা দিত। তখন আমি হয়তো ফাইভ–সিক্সে পড়ি। তখন এক–দুই টাকাই অনেক। একেকজনের কাছ থেকে বকশিশ নিতে নিতে হয়তো ২০-৩০ টাকা জমে যেত। সারা বছরের মধ্যে ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় ইনকাম।
আরেকটা বিষয় হলো, আমাদের ওখানে পূজার সময় মাঠে ফুটবল খেলা হতো। বিবাহিত বনাম অবিবাহিত। ছোটবেলায় যেহেতু আমি অবিবাহিত ছিলাম, সেহেতু আমি অবিবাহিতদের দলেই খেলতাম।
আমি রাজবাড়ী কলেজে পড়তাম। তো কলেজে পড়ার সময় দুর্গাপূজার আগে আগেই বাড়িতে চলে যেতাম। এখন ঢাকায় থাকার পরও বাড়ি যাওয়া মিস হয় না। আমি গ্রামের বাড়ি ছাড়া দুর্গাপূজা অন্য কোথাও করেছি, আমার এমনটা মনে পড়ে না।
আমাদের গ্রামের বৈশিষ্ট্যই ছিল, সেখানকার বাসিন্দারা যে যেখানেই থাকুক পূজার সময় বাড়ি চলে আসবে। এমনকি যেসব মেয়ের অন্য কোথাও বিয়ে হয়েছে, তাঁরাও স্বামী–সন্তান নিয়ে চলে আসবেন।
যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, তখন টিউশনি করতাম। তখন একটু দায়িত্ববোধের মতো বিষয় মনের মধ্যে এসেছিল। টিউশনির কিছু টাকা বাঁচিয়ে রাখতাম যাতে পূজার সময় মা–বাবার জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেতে পারি। বাবার জন্য হয়তো পাঞ্জাবি, মায়ের জন্য হয়তো শাড়ি কিনতাম।
এই বড়বেলায় এসেও অন্যান্যবার দুর্গাপূজার মাসখানেক আগে থেকেই ভেতরে-ভেতরে একটা আনন্দের আমেজ টের পেতাম। কিন্তু এবার যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে। এবার মনে হচ্ছে, বাড়িতে গিয়ে তো বাবাকে পাব না। এই প্রথম আমাকে বাবা ছাড়াই পূজার আনন্দে যোগ দিতে হবে।
এই দুঃখবোধ নিয়ে এবার পূজার আনন্দ উপভোগ করছি।
চঞ্চল চৌধুরী লেখক অভিনেতা